গত ৬ই জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ নামক একটি ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এসময় নিহত এক তরুণের ট্রেনের জানালায় ঝুলে থাকার একটি দৃশ্যকে কেন্দ্র করে একটি আবেগঘন গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। দাবি করা হয়, উক্ত যুবকের স্ত্রী এবং সন্তান ট্রেনের ভিতরে আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং সেই শোকে উক্ত যুবক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ট্রেন থেকে বের হননি। তবে ময়নাতদন্ত এবং ডিএনএ প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, ট্রেনে নিহত ৪ জনের মধ্যে কোনো শিশু ছিলেন না, এবং ট্রেনের জানালায় দেখা যাওয়া আলোচিত যুবকটির নাম ছিল আবু তালহা (২৩) এবং তিনি অবিবাহিত ছিলেন। অর্থাৎ, ছড়িয়ে পড়া গল্পটার সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
জনৈক মো হাফিজ উল্ল্যাহ তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেছেন, —– আজ বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দিয়েছে। ছবিতে পুড়ে যাওয়া লোকটির বউ এবং বাচ্চা পুড়ে মারা গেছে এজন্য উনি নিজ ইচ্ছায় আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করলেন। প্রতক্ষ্যদর্শীরা অনেক চেষ্টা করছে যখন তার শরীরের অর্ধেক পুড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু সে বলেছে আমার বউ, বাচ্চা মারা গেছে আমি বাঁচবো কাদের নিয়ে। —
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
৬ই জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে দি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত বেনাপোল এক্সপ্রেসে নিহত ৪ জন সম্পর্কে যা জানা গেল শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতরাতে ঢাকার গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে ট্রেনে আগুনে নিহত চার জনের মধ্যে তিনজন নারী ও একজন পুরুষ। বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন নিভিয়ে ফেলার পর গতকাল রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক উদ্ধারকারী বলেছিলেন, নিহতদের মধ্যে এক থেকে দুজন শিশু রয়েছে। আর ট্রেনের জানালায় যার মরদেহ ঝুলে থাকতে দেখা যায় তিনি পুরুষ। কিন্তু এর পরে অন্তত তিন জন নারীর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে তাদের স্বজন নিখোঁজ রয়েছেন যারা সবাই এই ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন। এতে নিহতদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে নিহতদের মধ্যে কোনো শিশু নেই। নিহতদের মধ্যে একজন পুরুষ ও অন্য তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী। ময়নাতদন্তের পর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন।
ঘটনার দিন, অর্থাৎ ৫ই জানুয়ারি তারিখেই নিহত একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে পুড়ে স্ত্রীর মৃত্যু, স্বামী কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন এর এই প্রতিবেদনে তাঁর নাম নাতাশা জেসমিন (২৫) ও তাঁর স্বামীর নাম আসিফ রহমান খান (৩০) বলে দাবি করা হয়েছিল। উভয়ে একই কামরায় ভ্রমণ করছিলেন। স্বামী আগুন থেকে বের হতে পারলেও স্ত্রী সেখান থেকে বের হতে পারেননি।
পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষা’র মাধ্যমে মরদেহ সনাক্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেসময়ে ঢাকা রেলওয়ে থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সেতাফুর রহমান বলেছিলেন, মৃতদের শরীর এতোটাই পুড়ে গেছে, যা দেখে চেনার কোনও উপায় নেই। এখন ময়নাতদন্তের সময়ে মৃতদেহ থেকে ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের নমুনা সংগ্রহ করার জন্য বলা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগকে। পরে সিআইডির মাধ্যমে দাবিদারদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। নমুনা ম্যাচ করলে এরপর স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় আবেদনকৃতদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ৪ টি মরদেহেরই পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। গত ১৫ই ফেব্রুয়ারি এই ৪ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরটিভির এই প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, এই ৪ জন হলেন রাজবাড়ির আবু তালহা (২৩), চন্দ্রীমা চৌধুরী সৌমি (২৮), এলিনা ইয়াসমিন (৪৪) ও পুরান ঢাকার নাতাশা জেসমিন নেকি (২৫)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেনের জানালার বাইরে দুই হাত বের করে যে বাঁচার আকুতি করার ছবি ভাইরাল হয়েছিল সেটিই ছিল আবু তালহার ছবি। তাঁর বাবা আব্দুল হকই এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন । আবু তালহা সৈয়দপুরের বাংলাদেশ আর্মি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
এলিনা ইয়াসমিন সম্পর্কে জানা যাচ্ছে যে, তিনি রাজবাড়ী পৌরসভার নুরপুর গ্রামের সাজ্জাদ হোসেনের স্ত্রী।
চন্দ্রিমা চৌধুরী সৌমি সম্পর্কে জানা যাচ্ছে যে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক এ ফার্মেসি বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত ছিলেন । তিনি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন প্রামাণিকের মেয়ে।
অর্থাৎ, আবু তালহা সম্পর্কে যে দাবি করা হচ্ছে ( ট্রেনের কামরায় তাঁর এক সন্তান এবং স্ত্রী নিহত হয়েছেন) সেই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। নিহতদের তালিকায় কোনো শিশু নেই ,বরং সবাই প্রাপ্তবয়স্ক । এবং আবু তালহা বিবাহিত ছিলেন মর্মেও তাঁর পরিবার থেকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
ঘটনার সময়কার কিছু ফুটেজ দেখে ধারণা করা যায়, আগুনের কারণে জনাব আবু তালহা বের হতে পারেননি। তিনি আংশিকভাবে শরীর বের করে, ২ হাত জানালার বাইরে বের করে রেখেছিলেন, কিন্তু শরীরের বাকি অংশ বের করে আনতে পারেননি । স্বেচ্ছায় তিনি ভেতরে থেকে গিয়েছেন- এই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই দাবিযুক্ত পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।