যা দাবি করা হচ্ছে : সমগ্র বাংলাদেশ যখন দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল এর বিয়েতে বিপুল জাঁকজমক করা হয়েছিল। যা পাওয়া যাচ্ছে : ১৯৭৪ এর মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছিল নভেম্বর-ডিসেম্বর এ ,আমন ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে। কিন্তু শেখ কামাল ও শেখ জামাল এর আনুষ্ঠানিক বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ই জুলাই ও ১৭ই জুলাই, যে সময়ে দুর্ভিক্ষের কোনো খবর পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায়নি।
“গল্প বলি – গল্প পাগল” গল্পের লিংক- Story Link নামক ফেসবুক গ্রুপে জনৈক Olhos de Fada একটি দীর্ঘ পোস্টে লিখেছেন, ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। এই দুর্ভিক্ষে অসংখ্য মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল।…………ঠিক সেই ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের মধ্যে মুজিবপুত্রের বিয়ে হয়েছিলো মহা ধুমধামের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে।
অনুসন্ধান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ সন্তানের মধ্যে ২ কন্যা ( শেখ হাসিনা ,শেখ রেহানা) ও ৩ পুত্র (শেখ কামাল,শেখ জামাল,শেখ রাসেল) সন্তান ছিল। এদের মধ্যে শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালে, শেখ জামালের জন্ম ১৯৫৪ সালে এবং শেখ রাসেল এর জন্ম ১৯৬৪ সালে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টের দাবি অনুযায়ী ,১৯৭৪ সালে ‘মুজিবপুত্রের’ বিয়ে হয়ে থাকলে , সে সময়ে শেখ কামালের বয়স ২৫, শেখ জামালের বয়স ২০ এবং শেখ রাসেলের বয়স ১০ (বিয়ের অনুপযুক্ত)।
ফলে ,শেখ রাসেলকে বাদ দিয়ে আমরা শেখ কামাল এবং শেখ জামাল এর বিয়ের তারিখ নিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করি।
আওয়ামী লিগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘সংস্কৃতিমান শেখ কামাল’ শীর্ষক একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ’৭৫-এর ১৪ জুলাই যেদিন গণভবনে শেখ কামাল ও শেখ জামাল দুই ভাইয়ের বিয়ে হয় ………
অর্থাৎ, এখানে তিনি দাবি করছেন, একই দিনে দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল। তবে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য নিবন্ধে ভিন্ন খবর দেখা যাচ্ছে।
‘দেশে বিদেশে’ পোর্টালে প্রকাশিত সাংবাদিক জাহিদ রহমান এর সুলতানা কামাল: বুলেটবিদ্ধ এক প্রিয়দর্শিনী অ্যাথলেট শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে , শেখ কামাল এর সাথে সুলতানা কামাল (বিয়ের পূর্বে সুলতানা খুকী) এর বিয়ে জয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে। এখানে কেবলমাত্র এক ভাইয়ের বিয়ের তথ্যই দেওয়া হয়েছে। দৈনিক বান্দরবন নামক পোর্টালে প্রকাশিত শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল এর বিবাহ শীর্ষক নিবন্ধেও একই তথ্য জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, শিক্ষক বাতায়নে জনৈক সহকারী শিক্ষক মোছাঃ লাকী আখতার পারভীন এর লেখা শেখ জামালের স্ত্রী রোজী শীর্ষক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামালের বিয়ের দিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমার জামালের জন্য বউ খুঁজতে দূরে যেতে হবে না। বিষয়টি ঐ দিন খোলাসা না করলেও পরের দিন ছোট বোন খাদেজা হোসেন লিলিকে ফোন করে বলেছিলেন তোমার রোজীকে আমি নিলাম।
তারপর ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মেঝ ছেলে শেখ জামালের সাথে রোজীর বিয়ে হয়। পরম আদরে ছেলে আর তার নববধূকে আশীর্বাদ করেন বঙ্গবন্ধু। বিয়ের সময় বদরুন্নেসা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন রোজী জামাল।
অর্থাৎ দিনটা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা না গেলেও এটা পরিষ্কার যে, বঙ্গবন্ধুর দুই পুত্রের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৫ এর জুলাইতে , এবং কোনোভাবেই ১৯৭৪ এ নয়।
অপরদিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দুর্ভিক্ষটা এসেছিল ১৯৭৪ এ। Olhos de Fada এর ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, এই দুর্ভিক্ষটা ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হয়ে সেই বছরেরই ডিসেম্বরের দিকে গিয়ে শেষ হয়। যমুনা টেলিভিশনের এই নিবন্ধে সাংবাদিক মিশুক নজীব লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের মার্চে শুরু হওয়া হাহাকার কেটে যেতে শুরু করে ডিসেম্বর নাগাদ। বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত ‘দুর্ভিক্ষ’ নামক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ১৯৭৪-এর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল এ দুর্ভিক্ষ।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এর ‘বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক বই, এবং অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান এর লেখা খাদ্য ও দুর্ভিক্ষের রাজনীতি শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ থেকেও ’৭৪ এর দুভিক্ষের একই সময়কাল জানা যাচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস এর পাতায় ১৩ই নভেম্বর,১৯৭৪ তারিখে প্রকাশিত Bangladesh Fears Thousands May Be Dead as Famine Spreads শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে,শীতকালীন শস্য উৎপাদন শুরু হয়েছে, এবং শহরে যারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন, তারা কাজ এবং খাদ্য পাওয়ার সম্ভাবনা দেখে ধীরে ধীরে গ্রামে যাওয়া শুরু করেছেন। একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছে, সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা কাটিয়ে ওটা সম্ভব হয়েছে। ( নভেম্বরের শীতকালীন শস্য বলতে সম্ভবত আমন ধান বোঝানো হয়েছে, যা সে সময়ে বাংলাদেশের প্রধান ফসল ছিল) ।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত আহমেদ মুনির উদ্দিন সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ :বাহাত্তর থেকে পচাত্তর’ বইয়ে চার বছরের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর ও সম্পাদকীয় সংকলন করা হয়েছে। এই বইটায় ‘দুর্ভিক্ষ’ শীর্ষক অধ্যায়ে দেখা গেল,সর্বশেষ ১৯৭৫ এর ২২শে জানুয়ারি তারিখে দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর পরে দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত আর কোনো খবর নেই ।
অর্থাৎ এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে ১৯৭৫ এর জানুয়ারির পর থেকে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।
সেক্ষেত্রে, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এ সকল পোস্টে ‘৭৪ এর দুর্ভিক্ষের মধ্যে মুজিবপুত্রের বিয়ে হয়েছিলো’ এমন দাবিটি খেলো হয়ে যায় । কারণ, আমরা অনুসন্ধানে দেখতে পেলাম, মুজিবপুত্রদ্বয়ের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, এবং তখন দুর্ভিক্ষের প্রকোপ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এ সকল পোস্টকে বিভ্রান্তিকর সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।