সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একজন বাবা এবং তার সন্তানের ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানকে শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচাতে তার বাবার বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, শেয়ারকৃত ছবিটি বাবার বুক ছিদ্র করে সন্তানকে অক্সিজেন দেয়ার নয়। বরং, প্রিম্যাচিউর সন্তানকে বাবার বুকের উপর রেখে স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি দেয়ার ছবি এটি। বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্ট, নিবন্ধ, এবং শেয়ারকৃত ছবিটিতে দৃশ্যমান ঐ শিশুটির মা জেনি সানচেজ (Jenny Sanchez) এর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। মূলত, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে জন্ম নেওয়া শিশুদেরকে জন্মোত্তর (Post-natal) বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যা থেকে সুরক্ষিত রাখতে বাবা কিংবা মায়ের বুকের সংস্পর্শে রেখে স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি দেওয়া হয়। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টের দাবিটিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির সাথে উত্থাপিত দাবির সত্যতা যাচাই করতে আমরা উক্ত ছবিটি ব্যবহার করে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করি এবং বেশকিছু ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্ট এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু নিবন্ধ খুঁজে পাই। ভারতীয় ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ফ্যাক্টলি (Factly) কর্তৃক প্রকাশিত “Photos of a father and son in skin-to-skin therapy are being misused to represent a false and unscientific narrative” শীর্ষক শিরোনামের একটি ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, ছবিটিতে দৃশ্যমান লোকটি জেনি সানচেজ এর স্বামী রাসেন ডিকি (RaSean Dickey), যিনি তাদের প্রিম্যাচিউর সন্তান ফনটেইন ডিকি (Fontaine Dickey) কে স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি দিচ্ছেন। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমের দাবি অনুযায়ী প্রিম্যাচিউর সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে রাসেন ডিকি এর বুকে কোন ছিদ্র করা হয়নি। তাছাড়া, ফ্যাক্টলি’র ঐ রিপোর্টটিতে ফনটেইন ডিকি’র মা জেনি সানচেজ এর একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়া গেছে। উক্ত অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জেনি সানচেজ তার প্রিম্যাচিউর সন্তান ফনটেইন ডিকি এবং স্বামী রাসেন ডিকি’র ছবি শেয়ার করেছেন এবং সেখানে তাদের সন্তানকে স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি দেওয়ার বিষয়টি হ্যাশট্যাগ ব্যবহারের মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন। জেনি সানচেজের শেয়ারকৃত তার স্বামী এবং সন্তানের বেশকিছু ছবি দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।
Image: Excerpt from the fact-checking report by Factly
আমাদের অনুসন্ধানে একটি তুর্কি সংবাদমাধ্যম থেকে প্রকাশিত নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া গেছে যেখানে বলা হয়েছে, জেনি সানচেজ এর প্রিম্যাচিউর সন্তান জন্মলাভের পর মস্তিষ্কজনিত রক্তক্ষরণ এবং মস্তিষ্কের উভয় পাশে জটিল সমস্যার শিকার হয়েছিলেন এবং এর চিকিৎসাস্বরূপ তার সন্তানকে ক্যাঙ্গারু ট্রিটমেন্ট বা স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি দেওয়া হয়েছিলো। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিরর এ একই ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে জেনি সানচেজের প্রিম্যাচিউর সন্তানের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা এবং তা থেকে উত্তরণের কথা উল্লেখ থাকলেও বাবার ফুসফুস ছিদ্র করে সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহ করার কোন কথা সেখানে ছিলো না। তাছাড়া, বুম বাংলাদেশ নামক একটি ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা এবং সায়েন্স বি (Science Bee) নামক একটি বিজ্ঞান শিক্ষা প্লাটফর্ম সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত বাবা এবং সন্তানের ছবির সাথে উত্থাপিত দাবিটি খন্ডন করে তাকে বিভ্রান্তিকর বলে রায় দিয়েছে।
Image: Excerpt from the article by Science Bee
স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি বা ক্যাঙ্গারু কেয়ার কি?
স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি বা কনটাক্ট হচ্ছে ইউনিসেফ ইউকে বেবি ফ্রেন্ডলি ইনিশিয়েটিভ স্ট্যান্ডার্ডস এর একটি কৌশল যা শিশুদেরকে জন্মের পর গর্ভাশয়ের বাহিরের জীবনে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে এবং মায়েদেরকে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ও স্নেহময় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। স্কিন-টু-স্কিন কেয়ার এবং ক্যাঙ্গারু কেয়ার প্রায় একই জিনিস, যেখানে একজন নবজাতক শিশুকে তার বাবা কিংবা মায়ের বুকের উপর রেখে শিশুর শরীরের তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন, এবং শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া, ক্যাঙ্গারু কেয়ার একজন মাকে তার মানসিক চাপ দূর করতে এবং সন্তানের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সময়ের আগে জন্মলাভ করা প্রিম্যাচিউর শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে জন্মের পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে স্কিন-টু-স্কিন কেয়ারের ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দিয়েছে।
Image: Excerpt from the UNICEF
অতএব, এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিতে বাবা তার বুক ছিদ্র করে ফুসফুস থেকে সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহ করছেন – শীর্ষক যে দাবিটি করা হয়েছে তা সঠিক নয়। বরং, ছবিতে বাবার বুকের উপর প্রিম্যাচিউর সন্তানকে রেখে স্কিন-টু-স্কিন থেরাপি বা ক্যাঙ্গারু কেয়ার দেয়া হচ্ছে।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিটির দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।