‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে আর্থিক সহায়তার নামে প্রতারণা

86
‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে আর্থিক সহায়তার নামে প্রতারণা
‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে আর্থিক সহায়তার নামে প্রতারণা

ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির নাম 'মানবতার ফেরিওয়ালা।' ফলোয়ার সংখ্যা ৩১ হাজার। অ্যাকাউন্টটি ঘুরে দেখা যায়, পোস্টগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসার সহায়তা সম্পর্কিত। এসব পোস্টে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কিছু আবেগঘন বাক্য, সহায়তার জন্য বিকাশ নম্বর এবং রোগী ও হাসপাতালের ঠিকানা। সেগুলো শেয়ারও হচ্ছে হাজার-হাজার। এর বাইরে সেখানে হারানো বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কিছু পোস্ট পাওয়া যাচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা সম্পর্কিত এসব পোস্টের অধিকাংশই ভুয়া। ভারতের বিভিন্ন ক্রাউড ফান্ডিং সাইট থেকে ভারতীয় রোগীদের ছবি সংগ্রহ করে তাদেরকে বাংলাদেশি দাবি করে চাওয়া হচ্ছে আর্থিক সহায়তা, যা আর্থিক প্রতারণার সামিল। 

অ্যাকাউন্টটি ঘুরে গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারিতে করা এমন প্রতারণার অন্তত ৫ টি ভাইরাল পোস্ট খুঁজে পেয়েছে ফ্যাক্টওয়াচ

১। রাঙ্গামাটির সদর হাসপাতালে ভর্তি কথিত কাইচার হোসেনের মেয়ে সুমাইয়ার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট

গত শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) মানবতার ফেরিওয়ালা অ্যাকাউন্টটিতে দুটি ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, কাইচার একজন রাজমিস্ত্রি, তার মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শিশুটির চিকিৎসার জন্য  প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। লোকটার একার দ্বারা এতো টাকা জোগাড় করা সম্ভব না। সাহায্য পাঠানোর জন্য যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে একটি বিকাশ নম্বরও (01882966980)। দিন তিনেকের ব্যবধানে পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ৪০ হাজারের বেশি।

রিভার্স ইমেজ সার্চ করে পোস্টে যুক্ত ছবি দুটি ভারতের ক্রাউড ফান্ডিং সাইট ইমপ্যাক্ট গুরুর (Impactguru) ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পাওয়া যায়। পেজটিতে ছবিগুলো ২০২৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পোস্ট করা হয়। ক্যাপশন থেকে জানা যায়, ছবিতে থাকা শিশুটির নাম হার্দিক। হার্দিক গুইলিয়ান-বার সিনড্রোম (Guillain-Barré syndrome- GBS) নামে একটি বিরল স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত। তাকে আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য পোস্টটির ক্যাপশনে ইমপ্যাক্ট গুরুর ওয়েবসাইটের একটি লিংকও দেওয়া রয়েছে।

এই লিংক থেকে জানা যায়, শিশুটির পুরো নাম হার্দিক রাজপুত। তার পরিবার ভারতের উত্তর প্রদেশের নয়ডার বাসিন্দা। বর্তমানে শিশুটি নয়ডার নিউমড সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি আছে। 

অর্থাৎ, ভারতের এক শিশুকে বাংলাদেশি দাবি করে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হচ্ছে।

২। কিশোরগঞ্জের সদর হাসপাতালে ভর্তি জান্নাত আক্তারের জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট

গত ১৬ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) অ্যাকাউন্টটি থেকে রনি মিয়া নামে এক দিনমজুরের মেয়ের গলায় ক্যান্সার হয়েছে দাবি করে এক কন্যা শিশুর চারটি ছবি পোস্ট করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, মেয়েটি বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি আছেন ।শিশুটির চিকিৎসার জন্য  প্রায় ৬ থেকে ৭ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এই পোস্টেও সাহায্য পাঠানোর জন্য যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে একই বিকাশ নম্বর (01882966980)। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পোস্টটি শেয়ার হয়েছে ৬৭ হাজারের বেশি।

এই কন্যা শিশুর ছবিগুলোও রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে পাওয়া যায় ইমপ্যাক্ট গুরুর (Impactguru) ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে। পেজটিতে ছবিগুলো গত মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) পোস্ট করা হয়। ক্যাপশন থেকে জানা যায়, মেয়েটির নাম সৃজা (৬ বছর)। সে একটি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি। পোস্টে যুক্ত লিংক থেকে জানা যায়, সৃজা মিত্র পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বাসিন্দা। সে বর্তমানে কলকাতার অ্যাপোলো মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

৩। ভারতীয় শিশু দক্ষ রায়কে বাংলাদেশি আয়েশা দাবি করে আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট

অ্যাকাউন্টটি থেকে একটি শিশুর দুটি ছবি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, তার নাম আয়েশা সিদ্দিকা। শিশুটির মাথায় ছিদ্র। তার চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। আরোও বলা হচ্ছে, মেয়েটি ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি, তার পরিবার চিকিৎসা চালাতে পারছে না। এই পোস্টেও একটি বিকাশ নম্বর যুক্ত করা হয়েছে (01739478657)।

এ ছবি দুটি পাওয়া যায় ইমপ্যাক্ট গুরুর (Impactguru) ভেরিফায়েড এক্স ( সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে। গত ৯ জানুয়ারি করা পোস্টে শিশুটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার নাম দক্ষ রায়। সে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। শিশুটি রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা। সে বর্তমানে কোনো হাসপাতালে ভর্তি নেই। 

৪। ভারতীয় ক্রাউড ফান্ডিং সাইট থেকে অন্তত ৪ বছরের পুরোনো ছবি ব্যবহার করে আবেগঘন পোস্ট

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ছোট শিশুসহ একটি পরিবারের ছবি অ্যাকাউন্টটিতে পোস্ট করে ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘একেবারে কোন টাকার প্রয়োজন নেই। মাত্র একটা শেয়ার আরো টাকা হাসপাতালে যাবে। এটা সম্পূর্ণ সত্য… দয়া করে সাহায্য করুন: হয়তো আপনার একটা শেয়ারে দয়াবান কোন ব্যক্তির নজরে আসতে পারে আমাদের এই  শিশুটির জন্য এক টু  সাহায্য করতে পারেন।’ 

রিভার্স ইমেজ সার্চ করে ছবিগুলো কিটো নামের আরেকটি ভারতীয় ক্রাউড ফান্ডিং সাইটের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছবিগুলো পোস্ট করা হয়েছিল। শিশুটির জন্য বর্তমানে আর অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে না। মানবতার ফেরিওয়ালার পুরোনো ছবিযুক্ত এই পোস্টটিই আজ সোমবার (২০ জানুয়ারি) পর্যন্ত ৯০ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে। 

৫। পুরোনো ছবি ব্যবহার করে আর্থিক সহায়তা চেয়ে পোস্ট

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর আপাদমস্তক ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো একটি শিশুর ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, শিশুটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার চিকিৎসায় আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। পোস্টে একটি বিকাশ নম্বরও (01714848512) যুক্ত করা হয়েছে।

ফ্যাক্টওয়াচ ছবিটি নিয়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতেই একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছবিটি অন্তত ২০২০ সাল থেকে ইন্টারনেটে বিদ্যমান। 

অর্থাৎ, পুরোনো ছবি ব্যবহার করে আর্থিক সহায়তা চেয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে পোস্টটিতে। 

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ মানবতার ফেরিওয়ালা অ্যাকাউন্টটিতে আর্থিক সাহায্য চাওয়ার এসব পোস্টগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।

ফেসবুকে প্রচারিত পোস্টগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। 

Claim:
ফেসবুক অ্যাকাউন্টটির নাম 'মানবতার ফেরিওয়ালা।' ফলোয়ার সংখ্যা ৩১ হাজার। অ্যাকাউন্টটি ঘুরে দেখা যায়, পোস্টগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসার সহায়তা সম্পর্কিত। এসব পোস্টে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে কিছু আবেগঘন বাক্য, সহায়তার জন্য বিকাশ নম্বর এবং রোগী ও হাসপাতালের ঠিকানা। সেগুলো শেয়ারও হচ্ছে হাজার-হাজার। এর বাইরে সেখানে হারানো বিজ্ঞপ্তি নিয়ে কিছু পোস্ট পাওয়া যাচ্ছে।

Claimed By:
Facebook Users

Rating:
False

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে

এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে
ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh