সিলেটের বন্যার জন্য কি ফারাক্কা বাঁধ দায়ী? 

144
সিলেটের বন্যার জন্য কি ফারাক্কা বাঁধ দায়ী? 
সিলেটের বন্যার জন্য কি ফারাক্কা বাঁধ দায়ী? 

Published on: [post_published]

ফেসবুকে যা ছড়াচ্ছেঃ একটি বাঁধ থেকে প্রবল বেগে জলরাশি ছাড়ার দৃশ্যকে দাবি করা হচ্ছে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের ভিডিও এবং এই বাঁধটি খুলে দেয়ার কারণেই নাকি ১৭ জুন ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে!

আসল ঘটনাঃ  দাবিটি মিথ্যা। প্রথমত, ভিডিওটি ভারতের ফারাক্কা বাঁধের নয় বরং দেশটির ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত পাঞ্চেত বাঁধের। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ভিডিওটি কমপক্ষে সাত বছর আগে থেকে দেখতে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, ফারাক্কা বাঁধ থেকে পানি ছাড়া বা পাঞ্চেত বাঁধের পানি সিলেটের বন্যার জন্য দায়ী নয়। কারণ দুটি বাঁধই সিলেট থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার মাঝামাঝি স্থানে গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত। এই গঙ্গা নদীর প্রধান অংশটি পরবর্তীতে পদ্মা নাম ধারণ করে রাজশাহী থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। কিন্তু এই নদী সিলেট বিভাগের কোনো জেলার উপর থেকে প্রবাহিত হয়নি। আর ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেয়ার জন্য যদি বন্যা হয় তাহলে বাংলাদেশে সবার আগে আক্রান্ত হবে রাজশাহী বিভাগ, সিলেট নয়।  অন্যদিকে পাঞ্চেত বাঁধ ঝাড়খন্ডের দামোদর নদীর উপর অবস্থিত, যেই নদীর কোনো অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। তৃতীয়ত, আসাম মেঘালয় এবং সিলেটে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে।  টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণেই মূলত সম্প্রতি সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোষ্ট দেখুন এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানঃ

সিলেট চলতি বছরের ২৯ মে প্রথম দফায় এবং ১৭ জুন দ্বিতীয় দফায় ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এই বন্যার মূল কারণ হল, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি। সিলেট হচ্ছে চেরাপুঞ্জির  সীমান্তবর্তী এলাকা এবং তুলনামূলকভাবে নিচু। ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল সিলেটের নদ-নদীগুলোতে দ্রুত পানি বাড়িয়ে দিয়েছে। এটাই সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার প্রধান কারণ।

পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, আসাম এবং মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর অধিকাংশই সিলেটে বয়ে চলে আসে। এই ঢলের সাথে প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ি বালু ও পলিমাটি বয়ে এসে সিলেটের নদ-নদীগুলোর তলদেশে জমতে জমতে গভীরতা হ্রাস করে দিচ্ছে।  এতে নদীগুলো ধীরে ধীরে সংকীর্ণ ও ভরাট হচ্ছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ এবং হাওরে বাঁধের কারণেও পানির প্রবাহপথে আরও বেশি বিঘ্ন ঘটে। ফলশ্রুতিতে ভারি বৃষ্টির পানিতে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়।

কিন্তু, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছ ফারাক্কা বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে দেয়ার কারণে সিলেটে বন্যা হয়েছে। এই পোস্টগুলোতে ফারাক্কা  বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার দৃশ্য দাবিতে একটি ভিডিও যুক্ত করা হয়েছে। তাই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য শুরুতেই ভিডিওটি ব্যবহার করে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে Satyam Sharma নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে ২৭ জুলাই ২০১৭-এ আপলোড করা একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভিডিওর শুরু থেকে ১৫ সেকেন্ড অংশটুকুর সাথে ভাইরাল ভিডিওটিএ হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মূল ভিডিওতে বাঁধটিকে ঝাড়খন্ডে অবস্থিত পাঞ্চেত বাঁধ বলে উল্লেখ করা হয়।

পরবর্তিতে প্রাসঙ্গিক কিছু কি-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করে পাওয়া ফারাক্কা বাঁধ এবং পাঞ্চেত বাঁধের ছবির সাথে ভাইরাল বাঁধটির তুলনা করা হয়। কিন্তু ভাইরাল বাঁধটির সাথে ফারাক্কা বাঁধের কোনো মিল পাওয়া যায়নি তবে, পাঞ্চেত বাঁধের সাথে বেশ মিল পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার মাঝামাঝি স্থানে গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত। গঙ্গা নদীর প্রধান অংশ “পদ্মা” নাম নিয়ে রাজশাহী থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপরে গোয়ালন্দে যমুনা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা নামেই চাঁদপুর জেলায় মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়। সবশেষে এই মিলিত প্রবাহ মেঘনা নাম নিয়েই দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়। এই নদী রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের ১০৯ টি জলকপাট রয়েছে। গঙ্গা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে এর সবগুলো জলকপাট একবারে খুলে দেয়া হলে বাংলাদেশ সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাজশাহীর নিম্নাঞ্চল। কারণ সিলেটের থেকে রাজশাহী বিভাগ ভৌগোলিকভাবে ফারাক্কা বাঁধের নিকটবর্তী।  কিন্তু নির্ভরযোগ্য কোনো উৎস থেকে রাজশাহী বিভাগে সম্প্রতি কোনো বন্যা হওয়া সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।  আবার, পাঞ্চেত বাঁধ ঝাড়খন্ডের দামোদর নদীর উপর অবস্থিত, যেই নদীর কোনো অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি। এই বাঁধ থেকে প্রবল বেগে পানি ছাড়লে সেই পানির কারণে বাংলাদেশের সিলেটে বন্যা হওয়া সম্ভব নয়।

সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.