পাগলা মসজিদ দানবাক্সের ৭ কোটি টাকা বন্যার্তদের দান করা হয়েছে?

32
পাগলা মসজিদ দানবাক্সের ৭ কোটি টাকা বন্যার্তদের দান করা হয়েছে? পাগলা মসজিদ দানবাক্সের ৭ কোটি টাকা বন্যার্তদের দান করা হয়েছে?

Published on: [post_published]

যা দাবি করা হচ্ছে: কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দান বাক্সের ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার টাকা, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য দান করেছেন মসজিদ কমিটি।

যা পাওয়া যাচ্ছে: কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের বান বাক্স ৩ মাস পর পর খুলে টাকা সংগ্রহ করে ব্যাংকে জমা করা হয় এবং বিভিন্ন খাতে খরচ করা হয়। ২০২৩ সালে সারা বছরে চার দফায় এই মসজিদ থেকে মোট ২১ কোটি টাকা সংগ্রহ কর আহয়েছিল। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আগস্ট মাসে এখান থেকে ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছে। এই টাকা দিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসার ব্যয় নির্বাহ সহ সুনির্দিষ্ট কিছু খরচ মেটানো হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক বন্যায় এই মসজিদের তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্যের কোনো ঘোষণা এখনো পর্যন্ত আসেনি। বরং মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার দাবিটি গুজব ছাড়া কিছু নয়।

গুজবের উৎস

ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখতে পাবেন এখানে, এখানে, এখানে ।

অনুসন্ধান

১৭ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম এ প্রকাশিত  পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলল ৭ কোটি ২২ লাখ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদের দানবাক্সে এবার মিলেছে সাত কোটির বেশি টাকা।

শনিবার সকালে মসজিদটির নয়টি দানবাক্স খুলে ২৮ বস্তা টাকা পাওয়া যায়। গণনা শেষে টাকার পরিমান দাঁড়ায় ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬। সেইসঙ্গে মিলেছে, বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনার গহনাও।

এবারের গণনা তত্ত্বাবধানকারী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কাজী মহুয়া মমতাজ টাকার পরিমান জানান।

এর আগে চলতি বছরের ২০ এপ্রিল মসজিদের নয়টি দানবাক্সে ২৭টি বস্তা থেকে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা পাওয়া যায়।

নগদ টাকার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা ও হীরাও পাওয়া যায় তখন।

সুউচ্চ মিনার ও তিনটি গম্বুজবিশিষ্ট তিনতলা বিশাল পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জের অন্যতম ঐতিহাসিক ধর্মীয় স্থাপনা। জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে হারুয়া এলাকায় মসজিদটি প্রায় চার একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত।

কথিত আছে, পাঁচশত বছর আগে বাংলার বারো ভুঁইয়া বা প্রতাপশালী বারোজন জমিদারের অন্যতম ঈশা খাঁর আমলে দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা নামে একজন ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরে ওই স্থানটিতে মসজিদটি নির্মিত হয়। জিল কদর পাগলার নামানুসারেই মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পায়।

সাম্প্রতিক সংগ্রহের এই ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার টাকা পুরোটাই বন্যার্তদের জন্য দান করা হয়েছে বলে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মসজিদের সংস্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এটি গুজব। এমন কোনো দানের ঘটনা ঘটেনি।

পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পাগলা মসজিদের ফান্ড থেকে বন্যা কবলিতদের মাঝে অনুদান দেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা ছড়িয়েছে, সেটি গুজব।’

মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‌‘মসজিদের টাকা অনুদান দেয়ার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্য নিতান্তই গুজব।’

সময়নিউজকে তিনি আরও বলেন, ‘মসজিদ পরিচালনার জন্য ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে। সবশেষ মসজিদের দানবাক্স থেকে টাকা পাওয়ার পর কমিটির কোনো মিটিং হয়নি। আর দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মিটিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। কাজেই কমিটির সভায় বন্যার্তদের জন্য মসজিদের টাকা অনুদান দেয়ার বিষয়টি সত্য নয়। এছাড়া ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে মসজিদ পরিচালিত হচ্ছে। তাই ইচ্ছে করলেই মসজিদের টাকা কোথাও অনুদান দেয়া সম্ভব না।’

এছাড়া, আরটিভির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পাগলা মসজিদ কমিটির কাছে বন্যার্তদের জন্য সাহায্য চেয়ে কেউ আবেদন করেনি। এ বিষয়ে আমাদের কোনো সভা হয়নি। মসজিদটি যেহেতু ওয়াকফকৃত সম্পত্তি, সেহেতু দানের টাকা ব্যয় করতে গেলে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় ব্যয় করতে হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিষয়টির কোনো সত্যতা নেই।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আরটিভি, সময় টিভি , বাংলা ট্রিবিউন এবং আজকের পত্রিকা। প্রত্যেকের প্রতিবেদন থেকেই জানা যাচ্ছে যে ৭ কোটি টাকা দান করার দাবিটি গুজব।

পাগলা মসজিদের দানের টাকা খরচ হয় কিভাবে ?

২০১৮ সালে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত বাংলাদেশের একটি মসজিদে দানবাক্সের সোয়া কোটি টাকা কী করা হবে? শীর্ষক প্রতিবেদনে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় জেলা প্রশাসক এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মূলত এই অর্থ মসজিদের বিভিন্ন কাজের যে খরচ সেখানে ব্যয় করা হয়। এছাড়া অন্যান্য মসজিদে পাঠানো হয়, এতিম খানাগুলোতে পাঠানো হয়।

২২শে এপ্রিল ২০২৪ তারিখে দেশ রুপান্তরে প্রকাশিত পাগলা মসজিদের দানের টাকা খরচ হয় যেভাবে শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াকফ এস্টেটের অডিটর দ্বারা পাগলা মসজিদের আয়-ব্যয়ের অডিট করা হয়। অডিটের পর প্রতি অর্থবছরে আয়ের ওপর ৫ শতাংশ ওয়াকফ প্রশাসন চাঁদা নিয়ে যায়। ব্যাংকে রাখা দানের টাকা থেকে মসজিদ-মাদ্রাসার ৩৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকা, আনসারের বেতন বাবদ প্রায় ২ লাখ, বিদ্যুৎ বিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মসজিদ-মাদ্রাসার গ্যাস বিল বাবদ প্রায় ১৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ বছরে প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়।

মসজিদ কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠিত নুরুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসায় অসহায় পিতৃ-মাতৃহীন এতিম শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা শুধু শিক্ষার্থীদের খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ভরণপোষণের ব্যয়ও নির্বাহ করা হয় মসজিদের দান থেকে পাওয়া অর্থে। প্রতিবছরই মসজিদের অর্থায়নে নতুন জামাকাপড় দেওয়া হয় তাদের।

দানবাক্স থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশের একটি বিশেষ অংশ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সহায়তা প্রদানের জন্য অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। ২০২১ অর্থবছরে ১২৪ জন দুরারোগ্য ব্যাধিতে (ক্যানসার, ব্রেন স্ট্রোক, হার্ট স্ট্রোক, কিডনি রোগ, প্যারালাইসিস ইত্যাদি) আক্রান্ত দরিদ্র ও অসহায়কে চিকিৎসা এবং দরিদ্র ও দুস্থ মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ বাবদ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা পাগলা মসজিদের ফান্ড থেকে অনুদান দেওয়া হয়। এ ছাড়া করোনাকালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

এই প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যাচ্ছে যে, ২০২৩ সালে চারবার খোলা হয়েছিল পাগলা মসজিদের দানবাক্স। চারবারে ২১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৮১ টাকা পাওয়া যায়।

উপরে উল্লেখিত হিসাবের সবগুলো খাত আমলে নিয়ে হিসাব করলে বছরে সর্বমোট ২ থেকে ৩ কোটি টাকা খরচের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। বাদবাকি অর্থের খরচের খাত খুঁজতে গিয়ে,জাগোনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম এ প্রকাশিত যেভাবে ব্যয় হয় পাগলা মসজিদের দানের টাকা শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, মানবকল্যাণসহ জেলার বিভিন্ন মসজিদ-মাদরাসার উন্নয়নে পাগলা মসজিদের দানের বিপুল পরিমাণ অর্থের লভ্যাংশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয়ে আসছিল। তবে কয়েক বছর ধরে জেলার বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসার উন্নয়নকাজে টাকা বরাদ্দ বন্ধ রয়েছে। কারণ পাগলা মসজিদ কমপ্লেক্সেকে আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামিক কমপ্লেক্সে নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে মসজিদ পরিচালনা কমিটি।……………………………।

পাগলা মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, পাগলা মসজিদের দানের টাকায় আন্তর্জাতিক মানের একটি ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। কমপ্লেক্সটি এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্থাপত্য হিসেবে বানানো হবে। এ জন্য আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি টাকা। সেখানে একসঙ্গে প্রায় ৩০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। ২০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। পাঁচ হাজার নারীর জন্য নামাজের আলাদা ব্যবস্থা থাকবে।

দৈনিক প্রথম আলো-তে ৯ই ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছয়তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। ——–ইতিমধ্যে এর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১২টি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করেছে। সেটির পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে রুয়েট প্রকৌশলীদের। তাঁরা যাচাই-বাছাইয়ের পর নকশা চূড়ান্ত করে দিলেই দ্রুত কাজ শুরু হয়ে যাবে। এতে প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা।

ভিন্ন এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন,  পাগলা মসজিদ ও ইসলামি কমপ্লেক্সের খরচ চালিয়ে দানের বাকি টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়।

তবে মসজিদের ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে কত টাকা জমা আছে, সেটার কোনো হিসাব প্রকাশ করেনি মসজিদ কর্তৃপক্ষ।

সিদ্ধান্ত

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাগলা মসজিদে সংগৃহীত আর্থিক অনুদান সম্পূর্ণরুপে বন্যার্তদের সাহায্যে প্রদান করার গুজবে ছয়লাব হয়ে গিয়েছে। মসজিদ কর্তৃপক্ষের প্রতি এক ধরনের চাপ ও তৈরি হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ( ২৪শে আগস্ট রাত ৮টা) মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে এটি সম্পূর্ণ্ গুজব। তারা বন্যার্তদের সাহায্যে এখনো কোনো আর্থিক সহায়তার সিদ্ধান্ত নেননি। সঙ্গত কারণে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

No Factcheck schema data available.