সম্প্রতি ফেসবুকে একটি সতর্কবার্তার পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে তাপমাত্রা বাড়লে গাড়ির জ্বালানি ট্যাংকে সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত পেট্রোল ভরতে নিষেধ করা হচ্ছে। কারণ এতে নাকি জ্বালানি ট্যাংক বিস্ফোরিত হতে পারে! একারণে গাড়িতে অর্ধেক জ্বালানি ভরতে বলা হচ্ছে এবং বাকি অর্ধেক বাতাস চলাচলের জন্য ফাঁকা রাখতে বলা হচ্ছে। কিছু কিছু ভাইরাল পোস্টে এই সতর্কবার্তার উৎস হিসেবে ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির সূত্র দেয়া হচ্ছে।
কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ভাইরাল হওয়া সতর্কবার্তাটি ইন্ডিয়ান অয়েল দেয় নি, বরং ইন্ডিয়ান অয়েল এর বিপরীত বার্তা দিচ্ছে। ফ্যাক্টওয়াচও এ ধরনের সতর্কবার্তার পক্ষে কোন প্রমাণ পায়নি। অতীতে গরম আবহাওয়ার কারণে গাড়ি বিস্ফোরণ হয়েছে এমন রেকর্ডও পাওয়া যায় নি।
১২ই এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে ইন্ডিয়ান অয়েল তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ Indian Oil Corporation Ltd একটি বিবৃতি পোস্ট করে। উক্ত পোস্ট থেকে জানা যায় “তাপমাত্রা বাড়লে গাড়ির জ্বালানি ট্যাংক সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত ভরা যাবেনা” — এমন কোন পরামর্শ ইন্ডিয়ান অয়েল দেয়নি । উক্ত পোস্টে ভাইরাল হওয়া দাবিটিও তারা খন্ডন করে। পোস্টের ক্যাপশনে লেখে “ইন্ডিয়ান অয়েল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা। শীত বা গ্রীষ্ম যেকোন সময় গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্দেশিত জ্বালানি ট্যাঙ্কের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত জ্বালানি ভরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।”
বর্তমানে ভাইরাল হওয়া দাবিটি পূর্বেও ভারতে বিভিন্ন সময় ভাইরাল হয়েছে। এ কারণে আগেও একই বিবৃতি স্যোশাল মিডিয়ায় দিয়েছে ইন্ডিয়ান অয়েল। এদের অফিশিয়াল টুইটার একাউন্টে একই বিবৃতি ২০১৮ , ২০১৯ এবং ২০২২ সালে দিতে দেখা যায়।
তাছাড়া ইন্ডিয়ান অয়েলের নাম ব্যবহার করে ছড়ানো এই মিথ্যা তথ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা খণ্ডন করেছে।
২০১৮ সালের ৬ জুলাই Petro Online নামক ওয়েবসাইটে “গরম আবহাওয়ায় গাড়ির জ্বালানী ট্যাংক সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত ভরা কি নিরাপদ” শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। উক্ত নিবন্ধে বলা হচ্ছে গাড়ি প্রস্তুতকারকরা গাড়ির নকশা এমনভাবে করেন যেন তা গরম, ঠাণ্ডাসহ সবরকম প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। তাই স্যোশাল মিডিয়ার গুজবে ভীত হওয়ার কিছু নেই।
উক্ত নিবন্ধে বরং চালকদের পর্যাপ্ত জ্বালানি নিতে পরামর্শ দেয়া হয় যাতে তারা জ্বালানি শেষ হয়ে তীব্র তাপপ্রবাহে আটকা না পড়েন।মটর সংস্থা আরএসির মূখ্যপাত্র রড ডেনিস বলেন “এর কোন সত্যতা নেই (ভাইরাল পোস্টগুলোর)। যানবাহনের জ্বালানি সিস্টেম এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন তা জ্বালানির প্রসারণ অথবা জ্বালানির থেকে আসা বাষ্প মোকাবেলা করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আগুন ধরতে গেলে বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রা ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হতে হবে যা বাস্তবে অসম্ভব।
উক্ত বিষয় নিয়ে করা Snopes এর ফ্যাক্টচেকিং রিপোর্ট থেকেও জানা আগুনের উৎস ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন ধরতে গেলে পরিবেশের তাপমাত্রা ৪৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে হবে যা সেলসিয়াস স্কেলে ২৫৭ ডিগ্রি ।
উক্ত প্রতিবেদনে Adnoc Distribution এর সহসভাপতি খালিদ হাদি জানান Adnoc Distribution এর কাছে পরিবেশের গরম তাপমাত্রার কারণে গাড়ি বিস্ফোরণের কোন রেকর্ড নেই এবং এটি অজানা কোন উৎস থেকে ছড়ানো হচ্ছে এবং এটি সম্পূর্ণ ভূয়া।
বিষয়টা ব্যাখ্যা করে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার জহিরুল ইসলাম জানান , কোন জ্বালানি কখন জ্বলবে তা নির্ণয় করা হয় ফ্লাশ পয়েন্ট আর ফায়ার পয়েন্টের মাধ্যমে। ফ্লাশ পয়েন্ট হলো যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় কোন জ্বলানি অন্য কোনো স্পার্ক বা আগুনের উৎসের সংস্পর্শে আসলে আগুন ধরে যায়। অন্যদিকে ফায়ার পয়েন্ট হলো যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় কোন জ্বালানি পদার্থ কোনো স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গের সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজেই জ্বলে উঠতে পারে।
যেমন, ডিজেল এর ফ্লাস পয়েন্ট ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফায়ার পয়েন্ট ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাত,৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা পেলে, এবং অন্য কোনো স্পার্ক বা আগুনের উৎস পেলে ডিজেল জ্বলে উঠবে। অন্যদিকে, ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর চেয়ে বেশি তাপমাত্রা হলে কোনো স্পার্ক বা আগুনের উৎস ছাড়াই ডিজেল নিজে নিজেই জ্বলে উঠবে।
আবার পেট্রোল এর ফ্ল্যাশ পয়েন্ট মাইনাস ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ফায়ার পয়েন্ট ২৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।অর্থাৎ স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায় কোনো স্পার্ক এর সাহায্যে পেট্রোলে আগুন জ্বললেও ২৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর নিচে এখানে নিজে নিজে আগুন জ্বলে ওঠার কোনো উপায় নেই।
যেহেতু বাংলাদেশ (বা বিশ্বের কোথাও) ২১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কখনো পড়েনি, সেহেতু ফুয়েল ট্যাংকের তাপমাত্রা এত বেশি হওয়া সম্ভব না। ফলে ডিজেল ভর্তি ফুয়েল ট্যাংক কখনো বিস্ফোরিত হবে না।
ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের মধ্যে ডিজেল (বা অন্য জ্বালানি) নিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাপমাত্রা বাড়ানো হয়। এরপর কার্বুরেটরের সাহায্যে একটি স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে জ্বালানো হয় , অথবা নিম্ন ফায়ার পয়েন্ট যুক্ত জ্বালানিদের ক্ষেত্রে কার্বুরেটর ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন জ্বলে ওঠে । তবে জ্বালানি ট্যাংকে যেহেতু উচ্চ চাপ প্রয়োগ করা হয়না, তাই পরিবেশের তাপমাত্রার কাছাকাছি তাপমাত্রাই সেখানে থাকবে। ২১০ ডিগ্রির মত এত উচ্চ তাপমাত্রা গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকে তৈরি হওয়া সম্ভব না। তাই সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন জ্বলে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সারমর্ম
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে ২ টা বিষয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে-
১। “অতিরিক্ত গরমে গাড়ির জ্বালানি ট্যাংক সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত ভরলে বিস্ফোরিত হতে পারে” এমন কোনো সতর্কবার্তা ইন্ডিয়ান অয়েল দেয়নি। ইন্ডিয়ান অয়েল তাদের ফেসবুক পোস্টে তা নিশ্চিত করেছে এবং ভাইরাল সতর্কবার্তাটিও তারা খণ্ডন করে দিয়েছে।
২। বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে ,গ্রীষ্মকালের অতিরিক্ত গরমে গাড়ির ফুয়েল ট্যাংক বিস্ফোরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এভাবে গাড়ির ট্যাংক বিস্ফোরণ হওয়ার কোন অতীত রেকর্ডও পাওয়া যায়নি।
একারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?