হিন্দু শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর ভিডিও নয় এটি

65
হিন্দু শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর ভিডিও নয় এটি হিন্দু শিক্ষককে জুতার মালা পরানোর ভিডিও নয় এটি

Published on: [post_published]

যা দাবি করা হচ্ছে : বাংলাদেশের একজন হিন্দু মহিলা শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং তাকে জুতোর মালা পরিয়ে রাস্তায় বের করা হয়েছে -এমন দাবি যুক্ত পোস্টের সাথে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে এক মহিলাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে উল্লাসরত জনতা মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছে।

যা পাওয়া যাচ্ছে: ভাইরাল ভিডিওতে উপস্থিত মহিলার ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি শিক্ষকতার সাথে জড়িত নন, বরং অসামাজিক কাজের অভিযোগে গত ১৭ই আগস্ট গাজীপুরে স্থানীয় ছাত্র-জনতা তাকে আটক করে গলার জুতার মালা পরিয়ে এভাবে মিছিল করেছিল।

গুজবের উৎস

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে ,এখানে,এখানে,এখানে

একই দাবিতে ইউটিউব এবং এক্সেও এই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়েছে। ( যেমন দেখুন এখানে,এখানে,এখানে)

জনৈক দীপক বোড়া (Depak Bora) ১৬ সেকেন্ডের এই ভিডিও আপলোড করে লিখেছেন,   হিন্দুবিদ্বেষী অসহিষ্ণু বাংলাদেশের একজন হিন্দু মহিলা শিক্ষককে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং তাকে জুতোর মালা পরিয়ে রাস্তায় বের করা হয়েছিল।

আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী আর্য সৌরভ দেব ( Arya Sourav Dev) এই ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে লিখেছেন, হিন্দু শিক্ষিকাকে জুতার মালা পড়িয়ে আনন্দোচ্ছ্বাস করছে ছাত্রছাত্রীরা। পিছনে দাঁড়ি টুপিওয়ালা ফেরেস্তা।

মূল ভিডিওর শব্দের উপরে বাড়তি মিউজিক যোগ করা হয়েছে, তাই মূল ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছেনা। তবে এরপরেও দুইশো/দুইশো-এমন একটি স্লোগান বোঝা যাচ্ছে।

অনুসন্ধান

প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চ করে দেখা গেল, ২০২২ সালের ১৮ই জুন তারিখে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে স্থানীয় ছাত্র-জনতা কিছুটা পথ হাটিয়েছিল, যে ভিডিও তখন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল। গণমাধ্যমেও এ খবর তখন প্রকাশিত হয়েছিল ( যেমন দেখুন এখানে,এখানে)।

সাম্প্রতিক ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা গেল, গত ২১শে আগস্ট ২০২৪ তারিখে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে রংপুর কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জুয়ারা পারভীনকে পদত্যাগে বাধ্য করিয়েছিলেন বর্তমান-প্রাক্তন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এদিন অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকে পদত্যাগের দাবি জানানোর এক পর্যায়ে কিছু শিক্ষার্থী অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে দেন (অধ্যক্ষ তখন সেটি খুলেও ফেলেন)।

এই অধ্যক্ষকে ‘হিন্দু মহিলা শিক্ষক’ দাবি করে একটি গুজব ভাইরাল হয়েছিল। তবে ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্টচেক বিভাগ দেখিয়েছে যে এই অধ্যক্ষ একজন মুসলিম এবং তাঁর নাম মঞ্জুয়ারা পারভীন।

তবে আলোচ্য ভাইরাল ভিডিওর সাথে রংপুরের মঞ্জুয়ারা পারভীন বা নড়াইলের স্বপন কুমার বিশ্বাস-কোনো ঘটনারই সাদৃশ্য নেই।

এ এফ পি ফ্যাক্টচেক এর বাংলাদেশ এডিটর কদরুদ্দিন শিশির এই ভাইরাল ভিডিওর মূল উৎস সনাক্ত করে ফেসবুকে নিজের প্রফাইলে লিখেছেন, ভিডিওতে যেই নারীকে দেখা যাচ্ছে, তিনি কোন শিক্ষক নন। গাজীপুর মাওনা চৌরাস্তা হাইওয়ে রোডে উড়াল সেতুর নিচে শিক্ষার্থীদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজির সময় ১৭ আগস্ট তাকে সহ আরো তিনজনকে হাতে নাতে ধরে শিক্ষার্থীরা।

পরে তাদের পুরুষ অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির মুখে কালো কালি এবং গলায় জুতা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আর নারী অভিযুক্তের গলা জুতার মালা দেয়া হয়।

এই স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে, জনৈক মানিক মন্ডল এর একাউন্ট থেকে ১৭ই আগস্ট আপলোড করা ২ মিনিট ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া গেল। এই ভিডিওর ক্যাপশন ছিল- দেহ ব্যবসায়ী,পাচারকারী ও চাঁদাবাজ আটক মাওনা চৌরাস্তা শ্রীপুর, গাজীপুর।

এটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাল ভিডিও নয়, তবে দুই ভিডিওর পাত্র-পাত্রী সহ অধিকাংশ চরিত্রই এক।  ঘটনাস্থল থেকে একই সময়ে ভিন্ন একটি ডিভাইস থেকে ভিন্ন এ্যাঙ্গেলে এই ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ভিন্ন -এ্যাঙ্গেল থেকে আরো কয়েকটি ভিডিও খুজে পাওয়া গেল। যেমন- চেঞ্জিং লাইফ নামক পেজ থেকে ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ড দৈর্ঘের এই ভিডিও পাওয়া গেল,যার ক্যাপশন ছিল –

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা চৌরাস্তায় ছাত্রজনতার হাতে দেহ ব্যবসায়ীরা আটক।

জাহাঙ্গির আলম এর আপলোড করা ৪ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের এই ভিডিওর ক্যাপশন ছিল- “ছিনতাইকারী ও দেহ*/ব্যাবসা ই’ চক্র! ছাত্র জনতার গণপিটুনি! মাওনা চৌরাস্তা, শ্রীপুর, গাজীপুর।“

এসব ভিডিও দেখা বোঝা যাচ্ছে, গাজীপুরের মাওনায় ট্রাফিক পুলিশের আদলে জ্যাকেট পরে কিছু তরুণ-তরুণী ১৭ই আগস্ট ডিউটি করছিলেন । (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৫ই আগস্ট এর পর থেকে দেশে আইন শৃংখলা বাহিনীর অনুপস্থিতির সময়ে তরুণ-তরুণীরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিলেন) । এই পটভূমিতে, ১৭ই আগস্ট ভিডিও ধারণকারীরা দেখতে পান, ২ জন পুরুষ ও একজন নারীকে এই স্বেচ্ছাসেবকরা আটক করে গণপিটুনি দিচ্ছে, এবং তাদের মুখে কালো কালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা ঝুলিয়েছে। তাদের সাথে চাঁদাবাজি ,দেহব্যবসা ও নারী পাচারের অভিযোগ করা হচ্ছে, তবে এসব অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ এই ভিডিওগুলোতে দেখা যায় নি। সবশেষে উক্ত নারীকে গলায় জুতার মালা পরানো অবস্থাতেই তরুণ-তরুণীরা মিছিল করে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যায়। এসময় তাদেরকে উক্ত নারীর প্রতি কিছু অবমাননাকর স্লোগান দিতে শোনা যায়, যার মধ্যে দুইশো/দুইশো স্লোগানটিও ছিল।

অভিযুক্ত ৩ জনের নাম বা ধর্ম পরিচয় কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে নারীটির পরনে নীল রঙের একটি বোরখা দেখা যায়, যা সাধারণত মুসলিম নারীদের পোষাক।

ভিডিওর একটি পর্যায়ে, উক্ত নারীর কপালে ও নাকে লাল রঙ দেখা যায়, যেটি বিবাহিত হিন্দু নারীদের পরিচয়সূচক সিদুরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
তবে ভাল ভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সিঁদুর যেখানে দেওয়া হয় (চুলের সিঁথিতে), এই লাল রঙ সেখানে অনুপস্থিত। বরং এই লাল রঙ কপালে,গালে, নাকে এবং ঠোঁটে লেগে রয়েছে।

এছাড়া , ভিডিওর কোনো কোনো পর্যায়ে তাঁর মুখে কোনো রঙই দেখা যায়নি।

তাছাড়া, এই নারীর হাতে কোনো শাঁখা দেখা যায়নি, যেটি বিবাহিত সধবা হিন্দু নারীর অপর সনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য।

উপরন্তু, বোরখা পরিহিত কোনো নারীর পক্ষে মাথায় সিঁদুর দেওয়া খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উক্ত ঘটনায় ধৃত ২ পুরুষের মুখে কালো কালি বা আলকাতরা দেখা গিয়েছে। উক্ত নারীর মুখেও অনুরূপভাবে ছাত্র জনতা কোনো ধরনের রঙ মাখানোর চেষ্টা করতে পারে।

গাজীপুরের এই ঘটনার বিষয়ে স্থানীয় কোনো সংবাদমাধ্যমে কোনো সংবাদ খুজে পাওয়া যায়নি । উক্ত নারী এবং পুরুষদের প্রকৃত অপরাধ কি,সেটা ফ্যাক্টওয়াচের পক্ষ থেকেও যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও থেকে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, উক্ত নারীকে শিক্ষকতার কারণে কোনো স্কুল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়নি , কিংবা তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো সদস্য নন।

সঙ্গত কারণে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভুল ক্যাপশনযুক্ত পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।

(আরো পড়ুন- বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ভুয়া তথ্য সংকলন)

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

No Factcheck schema data available.