জার্মানিতে ৬ বছরের ক্যান্সারাক্রান্ত বাচ্চার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে বিশাল মোটর বাইক র্যালির একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। যে ছবিটা ব্যবহৃত হচ্ছে, ফ্যাক্ট ওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে সেটা ২০২০ সালের জার্মানির নুরেমবার্গের একটি ছবি। সেটি কোনো মৃত্যুপথযাত্রী শিশুর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য ছিল না। বরং নতুন প্রস্তাবিত ট্রাফিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে এই ব্যতিক্রমী র্যালির আয়োজন করা হয়েছিল ।
বিভ্রান্তির উৎস
মোটরসাইকেল র্যালির ছবি সহ এই পোস্ট টি বিভিন্ন পেজ ,গ্রুপ এবং ব্যক্তির মাধ্যমে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে, এখানে , এখানে , এখানে ।
কি বলা হচ্ছে ভাইরাল পোস্টে ?
ভাইরাল পোস্টটিতে বলা হয়েছে , জার্মানিতে ৬ বছরের বাচ্চা ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং তার শেষ ইচ্ছা ছিল কিছু বাইকার যেন তার তার বাসার সামনে দিয়ে যায়। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে এবং মোটামুটি ২০-৩০জন বাইকারের আশা করে। প্রকাশের কিছু সময় পর জার্মানির প্রায় ১৫০০০ বাইকার তার বাসার সামনে আসে। তার ইচ্ছা পূরণ করে।
লক্ষণীয়, এখানে বাচ্চাটার নাম উল্লেখ করা হয়নি। শহরের নাম কিংবা ঘটনার দিন ,তারিখ উল্লেখ করা হয়নি।
এছাড়া, বাইকারদের গণজমায়েতের একটি ছবি প্রকাশ করা হলেও আলোচিত শিশুটির সাথে বাইকারদের কোনো ছবি, কিংবা শিশুটির একক কোনো ছবিও পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘটনাটা নিয়ে কয়েকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী সন্দেহ প্রকাশ করলে, কয়েকটি পেজ থেকে নতুন আরেকটি ভিডিও প্রচার করা হয় । দ্বিতীয় এই ভিডিওটিতে হুইল চেয়ারে এক শিশুকে বসে থাকতে দেখা যায় এবং বাইকাররা শিশুটিকে শুভেচ্ছা জানাতে জানাতে ছুটে যায়। এটিকে জার্মানির ঘটনা বলেই দাবি করা হচ্ছে। তবে এই ভিডিওতেও শিশুটির নাম, পরিচয়, সময় উল্লেখ নেই। বাচ্চাটিকে ‘৬ বছর বয়সী’ উল্লেখ করা হলেও তার শারীরিক গড়ন ৬ বছরের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
ভাইরাল ছবিটি অনুসন্ধানে দেখা গেল, এটি ২০২০ সালের ১৮শে জুলাই শনিবার এর ছবি। রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমে ruptly.tv সেদিন তাদের এই ওয়েবসাইটে এই ছবি এবং সংশ্লিষ্ট খবর প্রচার করেছিল ।
খবরে জানা যাচ্ছে, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জার্মান সরকার প্রতি রবিবার এবং ছুটির দিনগুলোতে টুরিস্ট স্পটগুলোতে মোটর বাইক নিষিদ্ধ করে একটি আইন প্রস্তাব করেছিল। এই খসড়া আইনের প্রতিবাদ হিসেবেই মোটরবাইকাররা সেদিন প্রতিবাদ করছিল।
রাপ্টলি টিভির ইউটিউব চ্যানেলেও মোটরবাইক র্যালির ভিডিও দেখা যাচ্ছে। রাস্তার বিভিন্ন মানুষ তাদের আন্দোলনে সংহতি সূচক অংগভঙ্গি করছে এবং প্লাকার্ড প্রদর্শন করছে।
শুধু নুরেমবার্গ নয়, জার্মানির অন্যান্য শহরেও (যেমন- হামবুর্গ , স্টুটগার্ড , হ্যানোভার ইত্যাদি) তখন মোটরসাইকেল র্যালি হয়েছিল।
দ্বিতীয় যে ভিডিওটি কে জার্মানির ঘটনা বলে দাবি করা হচ্ছে, ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে , সেটি ২০১৭ সালের ১২ই জানুয়ারি তারিখে অস্ট্রেলিয়ার একটি ভিডিও। ১৩ বছর বয়সী Cerebral palsy রোগে আক্রান্ত শিশু ‘জেন ইভান্স’ এর জন্মদিনের ইচ্ছা পূরণের জন্য Bunbury Bike Riders নামক একটি গ্রুপের শ’খানেক সদস্য তাদের বাইক নিয়ে হাজির হয়েছিল সেদিন। নির্দিষ্ট স্থানে তারা হুইলচেয়ারে বসা শিশুটিকে হ্যাপি বার্থডে বলে শুভেচ্ছা জানায়, বাইকের কসরত দেখায় এবং অনেকে শিশুটিকে জন্মদিনের উপহার দেয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বের অনেক দেশেই মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা গুরুতর অসূস্থ শিশুদের শেষ ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করা হয়। আমেরিকার মেক এ উইশ ফাউন্ডেশন ১৯৮০ সালে যাত্রা শুরু করে এখন পর্যন্ত কয়েকশো বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করেছে। এসব উইশ বা শেষ ইচ্ছার মধ্যে বিচিত্র বিষয়াদি ছিল। রেসলার জন সিনার সাথে দেখা করা থেকে শুরু করে পানির নিচে সাবমেরিন চালানো – বিচিত্র শেষ ইচ্ছা বাচ্চাদের। চেষ্টা করা হয় এসব ইচ্ছা পূরণ করার জন্য।
অন্য বিভিন্ন সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগেও বাচ্চাদের শেষ ইচ্ছা পূরণের চেষ্টা করা হয়।
আমেরিকার প্যাট্রিক কঙ্কলিন নামের এক অসূস্থ বাচ্চার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য ২০১৭ সালের ৭ই আগস্ট প্রায় ৩০০ বাইকার তার বাড়ির সামনে এসে জড়ো হয় এবং তাকে শুভেচ্ছা জানায়।
ইংল্যান্ডের পোর্টসমাউথে ২০২১ সালের ২১শে জুলাই একদল রাইডার হাসপাতালের বাচ্চাদের গিফটের খেলনা কেনার একটা মোটরসাইকেল র্যালি এবং ফান্ডরেইজিং প্রোগ্রাম করেন।
২০১৭ সালের ১২ই জুন আমেরিকার ইন্ডিয়ানাতে স্ট্যানলি নামের এক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রায় ১০০ মোটরসাইকেল তার বাসার সামনে জড়ো হয় এবং ইঞ্জিন চালু করে তাকে শুভেচ্ছা জানায় ।
বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটে। ‘রায়া’ নামের এক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ‘অটিজম ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’ নামের এক ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানান। ২০২০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কলের মাধ্যমে এই শিশুর সাথে কথা বলে তার ইচ্ছা পূরণ করেন।
তবে অনেক খুঁজেও নিকট অতীতে জার্মানির ৬ বছর বয়সী ক্যান্সারাক্রান্ত শিশুর ইচ্ছাপূরণে মোটর সাইকেল আরোহীদের সমাবেশের কোনো খবর খুঁজে পাওয়া গেল না। যে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে, সেটি ২০২০ সালের ১৭ই জুলাই তারিখের ছবি , যখন মোটরসাইকেল আরোহীরা একটি খসড়া আইনের প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়েছিল। কোন অসূস্থ বাচ্চার সাথে এই র্যালির কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই এই ভাইরাল ছবি এবং সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পোস্টকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ হিসেবে সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?