সম্প্রতি তুরষ্কের ভূমিকম্পের পিছনে আমেরিকার “হার্প (HAARP)” নামে একটি গবেষণা প্রোগ্রামকে দায়ী করে কিছু ফেসবুক পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে এর পিছনে যৌক্তিক কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এবং চূড়ান্ত কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। বরং রয়টার্স এর বরাতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে জানা যায়, “HAARP” এর সাথে ভূমিকম্পের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়া প্রোগ্রামটির ওয়েবসাইটেও প্রায় একই কথাই বলা হচ্ছে। তাই সঙ্গত কারণেই ফ্যাক্টওয়াচ এমন দাবিকে মিথ্যা চিহ্নিত করছে।
এসকল ফেসবুক পোস্টে অনেকগুলো দাবি করা হয় এর মধ্যে দুইটি উল্লেখযোগ্য দাবি হচ্ছে:
হার্পকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম ভূমিকম্প এবং সুনামি তৈরি সম্ভব।
আশঙ্কা করা হয়েছে তুরস্কের ভূমিকম্পের জন্যও হার্প দায়ী।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
পাঠকের সুবিধার জন্য অনুসন্ধানটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যাক। শুরুতে আমরা জানার চেষ্টা করবো হার্প কি এবং কি নিয়ে তারা কাজ করে। দ্বিতীয়ভাগে হার্প নিয়ে প্রচলিত কয়েকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে জানবো এবং সবশেষে হার্প ভূমিকম্প কিংবা সুনামি তৈরি করতে সক্ষম কি না এবং তুরস্কের ভূমিকম্পের সাথে আসলেই হার্পের কোনো যোগাযোগ আছে কি না তা খুঁজে বের করবো।
হার্প (HAARP) কী এবং কেন?
হার্পের পূর্ণরূপ হচ্ছে “দ্য হাই-ফ্রিকুয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম”। এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য হচ্ছে আয়নোস্ফিয়ার বা আয়নমন্ডলের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ নিয়ে গবেষণা করা। আয়নোস্ফিয়ার হচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৮ কিমি থেকে ৯৬৫ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুমন্ডলীয় এলাকা। এটি নিয়েই হার্প গবেষণা করে। সহজভাবে বললে, আয়নোস্ফিয়ারে উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও তরঙ্গ পাঠানো হয় এবং এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা হয়। হার্প এর অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায়। এটি ইউএস এয়ার ফোর্স, নেভি, ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকস এবং ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্টস এজেন্সির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চলে। ২০১৫ সালে স্থান পরিবর্তন করে এটিকে ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকসে নিয়ে আসা হয়।
উল্লেখ্য, হার্প পৃথিবীর একমাত্র প্রোগ্রাম না যেখানে আয়নোস্ফিয়ার বা এই ধরণের গবেষণা হচ্ছে। এমন আরোও কয়েকটি গবেষণা প্রোগ্রাম হচ্ছে:
আয়নোস্ফিয়ার রিসার্চ ফেসিলিটি, পোর্তো রিকো
আয়নোস্ফিয়ার রিচার্চ স্টেশন, ইউক্রেন
আয়নোস্ফিরিক হিটিং এন্ড শর্ট ওয়েভ, নরওয়ে
হার্প সম্পর্কিত বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
হার্প নিয়ে ইন্টারনেটে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এরমধ্যে উলেখযোগ্য-
আমেরিকান বিজ্ঞানী রোসালি বারটেল (Rosalie Bartell) ১৯৯৬ সালে এটিকে সামরিক অস্ত্র হিসেবে সতর্ক করেন।
কানাডিয়ান অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, হার্প বন্যা, হারিকেন, খড়া এমনকি ভূমিকম্পকে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
এছাড়া হাইতি, পাকিস্তান, ইরান, গ্রিস এবং ফিলিপাইনের বিভিন্ন দূর্যোগের কারণ হিসেবে বিভিন্নসময় হার্পের নাম সামনে আসে।
তবে এর কোনোটিরই বৈজ্ঞানিক কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। এর আগে এমন অভিযোগের বিপরীতে হার্প ২০১৬ সালে তাদের এই প্রোগ্রামটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে এবং মানুষকে সেটি ঘুরে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এমনই একটি ইউটিউব ভিডিওতে হার্পের ভিতরের বিভিন্ন জিনিস দেখানো হয় এবং সেখানে কর্মরত বিজ্ঞানীদের এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
হার্পের সাথে ভূমিকম্প এর কোনো সম্পর্ক আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সরাসরি হার্পের বরাতে কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে আবহাওয়া নিয়ে হার্পের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের ফ্রিকুয়েন্টলি আস্কড কুয়েশ্চন বিভাগে তাদের তরফ থেকে একটি উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে হার্প আবহাওয়া পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ করে না বলে জানায় তারা।
অন্যদিকে রয়টার্স ফ্যাক্ট চেকের একটি প্রতিবেদনসহ বেশ কিছু ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন পাওয়া যায় যেখানে তারা তুরষ্কের ভূমিকম্পের সাথে হার্পের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পায় নি। “Fact Check-Earthquake in Turkey was not a HAARP operation” শিরোনামে ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের বরাতে এমন দাবিটিকে মিথ্যা চিহ্নিত করেছে রয়টার্স। সেখানে কর্নেল ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরকে উদ্ধৃত করে সেখানে বলা হয়, হার্প ভূমিকম্প তৈরি করতে পারে সেটি তাত্ত্বিকভাবে অসম্ভব।
সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ কলরাডো বোল্ডার এর গবেষক ডেভিড মালাস্পিনা বলেন, হার্পে যে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহৃত হয় সেটি এএম রেডিওর মত এবং এর মধ্যে এমন কোনো মেকানিজম নেই যার ফলে ভুমিকম্প তৈরি হতে পারে। তিনি আরোও বলেন, এই তরঙ্গটি মূলত ভূমির ১ সেন্টিমিটার ভিতরে প্রবেশ করে, অন্যদিকে ২০২৩ এর ভূমিকম্পটি ভূমি থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার নিচে সংঘটিত হয়েছিলো।
এছাড়া ইউএসএ টুডের আরেকটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও প্রায় একই ব্যাখ্যা দিচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, তুরষ্কের ভূমিকম্পের পিছনে মানুষের সরাসরি কোনো হাত নেই। এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি ভূমিকম্প। বস্টন ইউনিভার্সিটির গবেষক র্যাচেল এবারক্রম্বি (Rachel Abercrombie) বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরণের ভূমিকম্প তৈরি করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। ভূপদার্থবিদ জেসিকা টার্নারও (Jessica Turner) একই তথ্যই দেন।
উল্লেখ্য, তুরস্কে এমন ভূমিকম্প এটিই প্রথম নয়। এর আগে ১৯৩৯ সালে ৭.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে সেখানে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলো। যা কিনা হার্প প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরেরও বেশি আগের ঘটনা।
তুরস্কে এমন ভূমিকম্পের কারণ ব্যাখ্যা করে এনপিআর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখা্নে মূলত তুরষ্কের ভৌগলিক অবস্থানকেই দায়ী করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে
তুরস্কের ভূমিকম্পের এমন মারাত্মক প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পিছনে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিএনএন। সেখানে আবহাওয়া, ভূমিকম্পের সময় এবং বেশি আফটারশক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
অতএব, হার্পকে কাজে লাগিয়ে কৃত্রিম ভূমিকম্প বা সুনামি তৈরি করার কোনো উপযুক্ত প্রমাণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। বরং অধিকাংশ তথ্যের ভিত্তিতে এটিই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, হার্পের এমন কোনো ক্ষমতা নেই। তাই অন্য দাবিগুলোও মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে যেখানে তুরষ্কের ভূমিকম্পের পিছনে হার্পকে দায়ী করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের পিছনে মানুষের পরোক্ষ অনেক ভূমিকা আছে যেমন- তেল উত্তোলন, হাইড্রোলিক ফ্র্যাকচার ইত্যাদি। কিন্তু পরোক্ষ ভূমিকা থাকলেও এখন পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে এমন নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প তৈরির কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচের বিবেচনায় এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি ভিত্তিহীন। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এমন দাবিকে মিথ্যা চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?