সম্প্রতি “ময়মনসিংহ সদরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু শিক্ষার্থীকে বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়” এমন দাবিতে শিক্ষার্থীর একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মূল ঘটনাটি ভিন্ন। যমুনা টিভির একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উক্ত শিক্ষার্থী এবং তার বাবার বক্তব্যে জানা যায়, মেয়েটি স্বেচ্ছায় শখ করে সেদিন বোরখা বা হিজাব পরেছিলো। তাকে কেউ বাধ্য করেনি। তার বান্ধবীদের সাথে মিল রেখে সম্পূর্ণ শখের বশেই তিনি বোরকা পরেছিলেন। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এমন দাবিকে “মিথ্যা” সাব্যস্ত করছে।
ময়মনসিংহ সদরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নাম,দাপুনিয়া কাওয়ালটি ইসলামিয়া হাইস্কুল এন্ড কলেজ। এ কলেজে হিন্দু মেয়েদের বোরকা পড়তে হয়। খবরটা শুনে একটু অবাকই হয়েছি। কারণ আমি এখন সুইডেনে অবস্থান করছি। ফলে সত্যাসত্য যাচাই করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।
এ পোস্টে বোরখা পরিহিতা যে মেয়েটিকে দেখছেন, তার নাম, চৈতী রাজভর। সে দশম শ্রেনীর ছাত্রী। তার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে আছে। আপাতত দিচ্ছি না, তার নিরাপত্তার কারণে। তার সাথে কথা বললে সে জানায় এ স্কুলের অলিখিত আইন হচ্ছে বোরখা পরা। সে পড়তে চায়,তাই বোরখা পরেই পড়ছে। তার মতো আরও দুই মেয়েও বোরখা পরে আসতো। তারপর তাদের মা –বাবা অন্য স্কুলে দিয়ে দিয়েছেন,আরও একজনের বিয়ে হয়ে গেছে।
এ স্কুলের এক শিক্ষকের নাম গোপা সরকার। মোবাইল নাম্বার 01726920329। তার সঙ্গে স্থানীয়ভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা যোগাযোগ করেন। তিনিও জন্মসূত্রে হিন্দু। উনার মোবাইল নাম্বার আমার কাছে আছে। কিন্তু তার নাম ও নাম্বার দিচ্ছি না নিরাপত্তার কারণে। তো সেই মুক্তিযোদ্ধা নেতা এ বিষয়ে সেই শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু বলেননি। পাশ কাটিয়ে যান।
পরে আমি যোগাযোগ করি ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে। উনার মোবাইল নাম্বার,01309111853 । উনাকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বখাটেদের উৎপাতের কারণে এখানকার মেয়েরা বোরখা পরে। অন্য কোন কারণে নয়।
এসব গত তিন/চারদিন আগের ঘটনা।
গতকাল আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটি ফোন আসে। ফোন যিনি করেন তিনি একজন হিন্দু নারী। বলেন, এসব নিয়ে কিছু লেখবেন না। হিন্দুদের তো এদেশে থাকতে হবে, পড়ালেখা করতে হবে। তাই চাপে নয় নিজের ইচ্ছাতেই মেয়েরা বোরখা পড়ছে। আর প্রধান শিক্ষক বোরখা পরলে খুশি হোন তাই বোরখা পরে যেতে বলেন। তবে চাপ নেই কোন।
আমি দুটো নাম্বার ও কিছু তথ্য দিয়ে দিলাম।
যাচাই বাছাই করতে পারেন সাংবাদিকরা বা যে কেউ।
ঘটনা যে সত্য এটা আমি কনফার্ম। ( যাদের নাম্বার দেওয়া হয়েছে তাদের অনুমতি নিয়েই দেওয়া হয়েছে)
প্রশ্ন , হিন্দুদেরও বোরখা পরতে হবে কেন?”
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
ফেসবুকে ভাইরাল ছবির মাধ্যমে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হলেও ছবির মূল সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে সূত্র হিসেবে “Debdulal Munna” নামের একজনের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে উক্ত আইডিটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
পোস্টের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করে ১১ এপ্রিল, ২০২২ এ যমুনা টিভি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। “সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রীকে বাধ্য করা হয়নি, শখ করে বোরকা পরেছিল সে” শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন এবং ভাইরাল ফেসবুক পোস্ট পর্যালোচনা করে বুঝা যায় প্রতিবেদনটি উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়। ময়মনসিংহের দাপুনিয়া কাওয়ালটি ইসলামিয়া হাই স্কুল এন্ড কলেজের ঘটনা এটি এবং যমুনা টিভিতেও বলা হচ্ছে Debdulal Munna নামের আইডি থেকেই তথ্যটি ফেসবুকে প্রচারিত হয়।
যমুনা টিভির প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীর ছবিটি ঢেকে দেওয়া হয় এবং ভাইরাল পোস্টেও শিক্ষার্থীর মুখে মাস্ক দেখতে পাওয়া যায়। তাই ভাইরাল ছবিটি সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাধ্যতামূলকভাবে বোরখা পরানোর সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং উক্ত শিক্ষার্থীর বাবাকে উদ্ধৃত করে সেখানে বলা হয়, তাকে বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়নি। বান্ধবীদের সাথে মিল রেখে শুধুমাত্র শখের বশেই সেই শিক্ষার্থী বোরকা পরেছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়,” শিক্ষিকা গোপা সরকার বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ও ছাত্রীর বোরকা পরা ছবি তুলে পাঠান বেসরকারি সংস্থা হাঙ্গার প্রোজেক্টের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী জয়ন্ত করের কাছে। তিনি এসব সরবরাহ করেন নান্দাইল সমূর্ত্ত জাহান মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক অরবিন্দ পালকে। এরপর সুইডেনে অবস্থানরত দেব দুলাল মুন্নার ফেসবুক আইডি থেকে দেয়া উস্কানিমূলক পোস্ট। জয়ন্ত কর এবং অরবিন্দ পাল দুজনই দাবি করলেন, এ ঘটনায় তাদের নেতিবাচক কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আর ওই ছাত্রীর ছবি তোলা শিক্ষক গোপা সরকার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বললেন, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া দেব দুলাল মুন্নার বিচার চান তিনি।“।
এই প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীর বাবা, তার পরিবারের সদস্য এবং তার নিজের বক্তব্য থেকে নিশ্চিত বুঝা যাচ্ছে যে তাকে কেউ বোরকা পরতে বাধ্য করেনি। এমনকি এই ঘটনার পিছনে জড়িতদের বিরুদ্ধে যেনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হয় এমন দাবি জানান এই শিক্ষার্থী।
এছাড়াও উক্ত বিদ্যালয়ে হিজাব বা বোরকা পরার কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কি না তা অনুসন্ধান করা হলে এর পক্ষে কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে রিউমার স্ক্যানারের একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন দেখতে পারেন এখানে।
সুতরাং, বিষয়টি পরিষ্কার যে উক্ত শিক্ষার্থী কারো কথায় নয়, বরং নিজ ইচ্ছায় শখের বশেই বোরকা পরেছিলেন। এছাড়াও উক্ত বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক বোরকা পরার বিধানেরও কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ মূল দাবিটি অর্থাৎ হিন্দু শিক্ষার্থীকে বোরকা পরতে বাধ্য করার ঘটনাটিকে “মিথ্যা” চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?