সম্প্রতি এইচএমপিভি বা হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস নামক সংক্রামক ভাইরাস নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশে এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে জনমনে আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু অনলাইন পোর্টাল এবং পত্রিকা বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশ করছে। এমনই একটি খবরের শিরোনাম ছিলো “বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আবারো আসছে লকডাউন!”। এই শিরোনামটি ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এইচএমপিভি ভাইরাসটি নতুন কোনো ভাইরাস নয়, ২০০১ সালে এটি আবিস্কৃত হয়। এমনকি ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেই বাংলাদেশে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি কম। যু্ক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঞ্জলিয়ার চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক পল হান্টার বলছেন “৫ বছর হওয়ার আগেই শিশু এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হয়। তাই দেহে এইচএমপিভির বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়।” তবে সম্প্রতি এই ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ায় চিকিৎসকেরা শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল তাদের সতর্ক থাকতে বলেছেন। তাদের শরীরের উপর এইচএমপিভি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলছে এটা অন্য শীতকালীন সংক্রামক রোগের মতোই একটি সংক্রামক রোগ। শীতের প্রভাব কমলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কমে যাবে। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
গুজবের উৎস
“বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আবারো আসছে লকডাউন!” এরকম শিরোনামে গত ৬ জানুয়ারি, ২০২৪ এ একটি খবর প্রকাশ করে দৈনিকজনকণ্ঠ, ভোরেরকাগজ, আমাদেরসময়সহ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। শিরোনাম এমন হলেও খবরগুলোর বিস্তারিত অংশে বলা হচ্ছে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। সেখানে অতীতের কোভিডের লকডাউনের কথা বলা হলেও এইচএমপিভি সংক্রমণের লকডাউন নিয়ে কিছু বলা হয়নি। অর্থ্যৎ, বলা যায় খবরটি ক্লিকবেইট শিরোনাম দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
এই খবরের শিরোনামটি ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনেক পোস্টে “বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে আবারো আসছে লকডাউন!” এই শিরোনাম থাকলেও মূল পোস্টের কোনো লিংক নেই।
৮ জানুয়ারি, ২০২৫ এ প্রথম আলো এইচএমপিভি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে একটি প্রতিবেদনপ্রকাশ করে। জানা যায়, হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি নেদারল্যান্ডসে প্রথম শনাক্ত হয়েছিল ২০০১ সালে। চীনে এইচএমপিভি নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে বলে জানা যায়। তবে এইচএমপিভি কোভিড–১৯–এর মতো মহামারি কোনো ভাইরাস নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভাইরাস দশকের পর দশক ধরে আমাদের মধ্যে রয়েছে আর বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগেই প্রায় সব শিশু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। তবে কোনো কোনো শিশু এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য এই ভাইরাস গুরুতর হতে পারে।
এইচএমপিভি দুই বা ততোধিক মানুষের সংস্পর্শে এসে ছড়ায়। আবার আক্রান্ত ব্যক্তি কোথাও স্পর্শ করলে, তা থেকেও ভাইরাসটি ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
প্রতিবেদনে সিঙ্গাপুরের সংক্রামক রোগের চিকিৎসক সু লি ইয়াং এর উদ্ধৃতিতে বলা হয়, “এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে দুই বছরের কম বয়সী ছোট শিশুরা। এ ছাড়া বৃদ্ধসহ যাঁদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাঁদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ঝুঁকিতে রয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরাও। আক্রান্ত হলে দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে ‘ছোট তবে উল্লেখযোগ্য’ অংশ গুরুতর শারীরিক সমস্যার মুখে পড়তে পারেন। তাঁদের ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে, ঘ্রাণ চলে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ‘ক্রুপ’ কাশি হতে পারে। এমন উপসর্গ দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা লাগতে পারে। তবে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম।”
অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটির মহামারি বিশেষজ্ঞ জ্যাকলিন স্টিফেনস বলেন, শুধু চীন নয়, উত্তর গোলার্ধের বিভিন্ন দেশেও এইচএমপিভির প্রকোপ বাড়ছে। এটা উদ্বেগের। তবে এটি শীতকাল বলেই এমন হচ্ছে।
যু্ক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাঞ্জলিয়ার চিকিৎসাবিদ্যার অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, ‘বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে প্রায় সব শিশু একবার হলেও এইচএমপিভিতে আক্রান্ত হয়। আমাদের জীবনে কয়েকবার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই আমি মনে করি না, বর্তমানে (এই ভাইরাসের কারণে) মারাত্মক কোনো বৈশ্বিক ইস্যু সৃষ্টির ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।’
৭ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে বিবিসিবাংলা প্রকাশিত একটা খবর থেকে জানা যাচ্ছে, এইচএমপিভি আক্রান্ত হয়ে চীনের হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে, এমন তথ্য নাকচ করে দিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। এই ভাইরাস নিয়ে এখনই ঘাবড়াবার কিছু নেই। বিবিসি বাংলার খবরে আরোও বলা হচ্ছে, এইচএমপিভি সংক্রমিত হলে সাধারণ জ্বর বা ফ্লুর মত উপসর্গ দেখা যায়।সাথে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ এবং শ্বাসকষ্ট হতে পারে। সাথে চামড়ায় র্যাশ বা দানা দানা দেখা দিতে পারে। আক্রান্ত হওয়ার পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে তিন থেকে ছয় দিন সময় লাগে।
চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশান বা সিডিসি’র তথ্য অনুযায়ী, এইচএমপিভি কোভিড-১৯ এর মতোই একটি আরএনএ ভাইরাস।এই ভাইরাসও শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে। তবে এরা একই পরিবারের ভাইরাস নয়। কোভিডের ইমিউনিটি এইচএমপিভি থেকে সুরক্ষা দেবে না। এই ভাইরাসের জন্য বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতিও নেই৷ চিকিৎসকেরাসাধারণত লক্ষণ বুঝে তা উপশমের চেষ্টা করে থাকেন। যেমন জ্বর হলে তাপমাত্রা কমানোর ওষুধ দেন। সর্দি গলাব্যথা বা শ্বাস নিতে সমস্যা হলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা বা ওষুধ দেয়া হয়।চিকিৎসকেরাবেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীকে বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত পানি জাতীয় খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এই ভাইরাসের চিকিৎসায় অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন সাংহাই হাসপাতালের চিকিৎসক এবং বাংলাদেশের ভাইরোলজিস্টরা।
আমেরিকার সিডিসির (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল) বরাত দিয়ে তারা জানাচ্ছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে কোন বয়েসী মানুষের ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়ার মত অসুখ হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি শিশু, বয়স্ক মানুষ এবং যাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল তাদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে।
বিবিসি বাংলার খবরে বলছে বাংলাদেশের ভাইরোলজিস্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি জানিয়েছে, এইচএমপিভি নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভাইরোলজিস্ট মাহবুবা জামিল বলেছেন, কোভিড ফুসফুসের যতটা ক্ষতি করে, এইচএমপিভিতে ততটা ক্ষতি হয় না। শিশু, বয়স্ক, গর্ভবতী বা কঠিন কোনো রোগে আক্রান্তদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ তীব্র হতে পারে। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকে। সেক্ষেত্রে সবসময় সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এইচএমপিভি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে গার্ডিয়ান, আলজাজিরা, ইন্ডিপেন্ডেন্টইউকে সহ আরো অনেক গণমাধ্যম। সব প্রতিবেদনেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ভাইরাস নিয়ে এখনই আশঙ্কার কিছু নেই।
৭ জানুয়ারি, ২০২৫ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (World Health Organization) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উত্তর গোলার্ধের অনেক দেশে এ সময় মৌসুমী শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আরোও বলা হয়, মৌসুমি আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে ইনফ্লুয়েঞ্জা, রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV), এবং অন্যান্য সাধারণ শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাসের মতো এইচএমপিভি ভাইরাস সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা অনেকগুলো দেশে এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব অঞ্চলে শীতকাল চলছে, সেখানে বাসিন্দাদের শ্বাসযন্ত্রের রোগজীবাণুর বিস্তার রোধ এবং ঝুঁকি হ্রাস করতে সাধারণ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। যাদের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মৃদু উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তাদের ঘরে থেকে বিশ্রাম নিতে বলা হয়েছে এবং যারা তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে তাদের যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে বলা হয়েছে।
৮ তারিখ প্রকাশিত ভারতের এনডিটিভির খবরে জানা যাচ্ছে, ভারতে ৮ জন এইচএমপিভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে এবিপি লাইভের খবরে জানাচ্ছে মোট ৯ জন আক্রান্ত্র হয়েছে। এই খবরগুলো থেকে জানা যাচ্ছে আক্রান্ত হওয়া সব রোগীর বয়স ১৮ বছরের কম। এদিকে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য এমপিভি সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে ভারত জুড়ে এখনো কোনো লকডাউনের ঘোষণা আসেনি। চিকিৎসকেরা এই সংক্রমণ নিয়ে বেশি আতঙ্কিত না হতে বলেছেন।
তাছাড়া এখন অব্দি বিশ্বের কোন দেশ উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে লকডাউন কর্মসূচি দেয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশে এইচএমপিভি আক্রান্ত কোন রোগী এখনো পাওয়া যায়নি। তাই বাংলাদেশে এখনই লকডাউনের প্রশ্নই আসে না। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া তথ্যটিকে ফ্যাক্টওয়াচ “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
No Factcheck schema data available.
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের
নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।
কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh