“১৫ বছরপরেওকবরথেকেঅক্ষতঅবস্থায়উঠললাশ!!!’’ শিরোনামে গত ২৯শে জুন থেকে অনলাইনে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে কুষ্টিয়ায় একটি অক্ষত লাশ উদ্ধারের দাবি করা হয়েছে। ভিডিওতে মৃতদেহের কাফনের কাপড় মোটামুটি অক্ষত দেখা গেলেও তার শরীর কতটুকু অক্ষত রয়েছে সেটা দেখানো হয়নি। মৃতদেহের একটিমাত্র অংশ আংশিকভাবে দেখানো হয়েছে ভিডিওতে, যা দেখে সেটাকে মৃতদেহের কংকালের অংশ বলেই মনে হয়েছে।
দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃতদেহ সংরক্ষণের ঘটনা এবং ছবি পাওয়া গেলেও, কুষ্টিয়ার এই কথিত ‘অক্ষত লাশ’ এর অক্ষত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ না পাওয়ায় ফ্যাক্টওয়াচ টিম এই দাবিকে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : এই নিবন্ধে বিভিন্ন মৃতদেহের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সংবেদনশীল পাঠকদের এই নিবন্ধটি এড়িয়ে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। গুজবের উৎস
মূল উৎস শনাক্ত করা না গেলেও ভিডিওর ধারাভাষ্যে ‘আর কে মিডিয়া’র কথা পাওয়া যাচ্ছে।
ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, কুষ্টিয়া জেলার সদর উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের ৬ নাম্বার ওয়ার্ডের কীর্তিনগর গ্রামের একটি পুরাতন কবর স্থানান্তর করতে গিয়ে গত ৩০শে মে তারিখে এই অক্ষত লাশ পাওয়া যায়।
ভিডিওর দাবি অনুযায়ী, কীর্তিনগর কেন্দ্রীয় মসজিদের উত্তর প্রান্তে মসজিদের প্রাক্তন খাদেম আবু তালেব ও তার স্ত্রী সূর্যনেছা (মৃত্যু ২০০৬)’র কবর ছিল। মসজিদ সংস্কারের কারণে সূর্যনেছার কবর স্থানান্তর করার দরকার পড়েছিল। এ কারনে সূর্যনেছার কবর খোড়ার পরে খননকারীরা অক্ষত লাশ দেখতে পায়। দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ এই অক্ষত লাশ দেখতে আসে। কয়েক ঘণ্টা পরে তাকে আবার মসজিদ থেকে দূরে, নতুন স্থানে (কীর্তিনগর কেন্দ্রীয় কবরস্থান) এ দাফন করা হয়।
ভিডিওতে স্থানীয় আমজনতা এবং ধর্মীয় প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হলেও, কোনো ডাক্তার, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কারো সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়নি।
এই ভিডিওটাই ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা যায়।
অনেকে মূল ভিডিওর পরে গজল যোগ করে প্রচার করেন। অনেকে আবার এটাকে ‘লাইভ ভিডিও’ হিসেবে প্রচার করেন, যেখান থেকে দর্শকরা বিভ্রান্ত হতে পারে।
সূর্যনেছার পুত্র , এবং প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ মুজিবর রহমান ভিডিওতে বলেন, “লাশ উত্তোলনের পরে আমরা দেখলাম, কাফনের কাপড়টা খুব সুন্দর আছে। নষ্ট হয়নি। শরীরের হাড়-হাড্ডি যেমন থাকার কথা, তেমনি সাজানো আছে। মাংস নাই, শুধু হাড় হাড্ডি আছে।“
(প্রতিবেদক এ সময় নিজে থেকে প্রশ্ন করেন, লাশটাকে তাহলে অক্ষতই বলা যায় ? এবং মজিবুর রহমান তখন বলেন, হ্যা, অক্ষতই বলা যায়)
ভিডিওর ৪৬তম সেকেণ্ডে ময়লা মাটিমাখা কাফনের কাপড় সরিয়ে লাশের মুখমণ্ডলের একটা অংশ দেখানো হয়। যে অংশটাকে মাথার খুলি/করোটির অংশ বলে ধারণা করা যায়।
এটুকু ছাড়া লাশের আর কিছুই দেখানো হয়নি। কাজেই লাশের ‘অক্ষত’ থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না।
লাশ এবং কংকাল কত দিনে পচে ?
কোনো মরদেহ কবর দেওয়ার পরে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, ব্যাক্টেরিয়া এবং অন্যান্য অনুজীব মৃতদেহের মাংস খেতে থাকে এবং পচনে সাহায্য করে। Manual of Forensic Odontology জানাচ্ছে , সর্বনিম্ন ৩ সপ্তাহ থেকে শুরু করে বছরখানেকের মধ্যে মৃতদেহের সব মাংস,চামড়া বিযোজিত হয়ে যায়। কবরে তখন শুধু কংকাল থাকে। এই কংকাল ও চিরস্থায়ী নয়। ২০ বছরের মত কংকাল স্থায়ী হয়। এরপরে কংকালও ক্ষয়ে যেতে থাকে।
তবে পরিবেশ ভেদে এই সময় কম বেশি হতে পারে। যেসব এলাকার মাটিতে যথেষ্ঠ অনুজীব নেই ,কিংবা যেখানের মাটি অতিরিক্ত লবণাক্ত , কিংবা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, কিংবা বন্যার কারণে মাটি পানিতে ডুবে গেছে, সেসব এলাকায় লাশ পচতে দেরি হয়। এমনকি , যেখানে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম, তেমন কিছু কিছু এলাকায় পুরোপুরি লাশ প্রাকৃতিকভাবেই পুরোপুরি মমি হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। একে natural mummification বলে ।
গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. আবু হানিফ ২০১৯ সালের এক সাক্ষাতকারে বলেন, “মৃত্যুর পর দাফন করা হলে কিছু দিনের মধ্যেই মানুষের দেহের সব টিস্যু ও অঙ্গ পচে যাবে এটাই স্বাভাবিক। আবার খনিজ বা রাসায়নিকসহ নানা কারণেই লাশ পচতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তবে এটি নির্ভর করে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, কীটপতঙ্গের উপস্থিতি, বাতাসের উপস্থিতি, মাটির অম্লতা ইত্যাদির ওপর।“
মৃতদেহকে মুড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাফনের কাপড় ব্যবহার করা হয়। উপাদানভেদে এই কাফনের কাপড় পচতেও একেক রকম সময় লাগে। সুতি কাপড়ের তুলনায় পলিয়েস্টার জাতীয় কাপড় পচতে অনেক দেরি হয়।
মৃতদেহ কি অক্ষত থাকতে পারে?
নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক পদার্থ এবং পদ্ধতির মাধ্যমে সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানব শরীর সংরক্ষণ করার রেওয়াজ ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা এই পদ্ধতিতে পিরামিডের মধ্যে তাদের ফারাও (রাজা/রাণী) এবং ফারাও এর নিকটজনদের মমি করে রাখত। প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো সেই মমিগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে।
বিজ্ঞানীরা এই মমিগুলো নিয়ে গবেষণা করেন। এই মমিগুলো এত ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত আছে যে, বিজ্ঞানীরা এখনো এদের কোষ থেকে ডিএনএ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেন । সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে এদের দেহ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কার করা যাচ্ছে এখন।
সাম্প্রতিক সময়েও অনেক দেশের শাসনকর্তাদের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তাদের দেহ মমি করে রাখা হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (মৃত্যু ১৯২৪) এবং চীনের প্রেসিডেন্ট মাও জে দং (Mao ZeDong) ১৯৭৬ সালে মৃত্যুবরণ করার পর তাদের দেহ মমি করে রাখা হয়েছে। এত বছর পরেও তাদের দেহ অক্ষত আছে।
বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের মৃতদেহ সাথে সাথে সৎকার না করে কয়েক মাস মমি করে রাখা হয় তাদের মন্দিরে। এরপরে কোনো শুভক্ষণে তাদের দাহ করা হয়। ধর্মীয় সম্মান অনুযায়ী একেকজনের জন্য একেক সময় নির্ধারণ করা হয়। যেমন- সত্যপ্রিয় মহাথেরোর মৃতদেহ মমি করে রাখা হয়েছিল১৪৮ দিনের জন্য।
বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহারগুলোতে গেলে মাঝে মাঝেই কোনো বৌদ্ধ ধর্মগুরুর এমন সংরক্ষিত মৃতদেহ চোখে পড়ে।
তবে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ ছাড়াও প্রাকৃতিক উপাদানের কারণে দেহ সংরক্ষণের কিছু ঘটনা পাওয়া যায়।
যেমন-১৯৯১ সালে আল্পস পর্বতের চূড়ায় একটি মরদেহ পাওয়া যায় ,যেটি তীব্র ঠাণ্ডার কারণে নষ্ট না হয়ে প্রায় ‘অক্ষত’ ছিল। কার্বন ডেটিং থেকে জানা যায়, এটি ছিল খৃষ্টপূর্ব ৩৪০০ সালের একটি মৃতদেহ।বিখ্যাত এই মমিটি Ötzi নামে পরিচিত।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
উপযুক্ত পরিবেশ পেলে কোনো লাশ দীর্ঘদিন না পচেও অক্ষত থাকতে পারে। তবে কুষ্টিয়ার কীর্তিনগর গ্রামের মরদেহটি পচে গিয়ে শুধুমাত্র কংকাল অবশিষ্ট আছে বলে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে । স্থানীয়রাও সে কথাই বলেছেন। অতএব, ‘’১৫ বছর পরেও অক্ষত লাশ’’ শিরোনামটি “বিভ্রান্তিকর” এবং “অসত্য” বলেই ফ্যাক্টওয়াচ মনে করে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?