কথিত ‘অক্ষত লাশ’ এর একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ৩২ বছর কবরে শুয়ে থেকেও তার শরীরে কোনো পচন ধরেনি এবং তিনি অক্ষত আছেন। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটি ৩২ বছরের পুরনো কোনো লাশ নয়, বরং বিদ্যুতায়িত হয়ে আহত এক ব্যক্তির ছবি এটি।
গুজবের উৎস
দীর্ঘদিন ধরে এসব পোস্ট ফেসবুকে দেখা গেলেও সম্প্রতি আগস্ট মাসের শেষের দিকে এটি অনেক বেশি ভাইরাল হয়।
এসব পোস্টে ৩ টি ছবি যুক্ত করে ক্যাপশনে বলা হয়েছে, তিনি ৩২ বছর আগে মারা গিয়েছিলেন,যখন তাকে কবর থেকে উঠানো হয় মনে হচ্ছিলো, তিনি কয়েক ঘন্টা আগে ঘুমিয়েছিলেন, এটি সম্মানজনক মৃত। আল্লাহ আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
কথিত মৃত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা কিংবা অন্য কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি এই ক্যাপশনে।
ছবি ৩ টাতে দেখা যায়, একজন প্রবীণ ব্যক্তি মাটিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন । মাথার অংশ বাদে তার শরীরের উপরে মাটি চাপা দেওয়া রয়েছে। তিনি জীবিত কি মৃত বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার শরীরের কোথাও কোনো পচন নেই । পরনে সাদা রঙের একটা কাপড় দেখা যাচ্ছে , যেটা কাফনের কাপড় হতে পারে আবার পরিধেয় কাপড় বা অন্য কোনো কাপড় ও হতে পারে। মাথার নীচে আবার নীল রঙের পাগড়ির মত এক টুকরা কাপড় দেখা যাচ্ছে।
ফ্যাক্ট ক্রিসেন্ডো আফগানিস্তান এর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, টুইটারে এই ছবিটা ব্যবহার করে সবচেয়ে পুরনো যে পোস্ট করা হয়েছিল, সেটি ২০১৯ সালের ২৩শে জুন এর। ট্রু জার্নালিজম নামের এই একাউন্ট থেকে এই পোস্টে বলা হয়, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী এই একাউন্ট হোল্ডারকে জানিয়েছেন, তারা বাবা বিদ্যুতায়িত হয়েছেন । তার বাবার কয়েকটি ছবি দিয়ে তিনি সবার কাছে তার আহত বাবার জন্য দোয়া কামনা করেছেন ।
অন্যদিকে, রিউমার স্ক্যানার এর অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের ২২শে জুন তারিখে Ali Sherazi নামক ফেসবুক একাউন্ট থেকে উর্দু ভাষায় এই পোস্ট করা হয়েছিল।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানেও দেখা যাচ্ছে ,২০১৯ সালের ২২শে জুন ফেসবুকে এই ছবিসহ অনেকগুলো উর্দু পোস্ট এসেছিল, যাদের মধ্যে আলি সিরাজী’র পোস্ট ই ছিল সর্বপ্রথমে (২২শে জুন রাত ৮ টা ৫৭ মিনিটে)
মূল পোস্টকারী কিংবা এই ছবির সাথে সংশ্লিষ্ট কাউকে অনুসন্ধানে খুজে পাওয়া যায়নি। একইসাথে, ছবিতে থাকা ব্যক্তির শেষ পরিণতি সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি।
ছবিতে কি ঘটছিল ?
পাকিস্তান এবং ভারত এর বিভিন্ন এলাকায় কেউ বিদ্যুতায়িত হলে তাকে কাদামাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কুসংস্কার প্রচলিত আছে । যেমন দেখুন ভারতের উত্তর প্রদেশের পিলভিট , এবং বেরিলি তে ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে আহত ব্যক্তির কোনো উপকার হয় না, বরং তার হৃদপিন্ড বা শ্বাস-প্রশ্বাস অচল হয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে সিপিআর (cardiopulmonary resuscitation) দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাকিস্তানের National Electric Power Regulatory Authority তাদের ওয়েবসাইটে বিদ্যুতায়িত ব্যক্তির গায়ে কাদা,মাটি বা বালি দিয়ে না ঢেকে তাদেরকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে । এ থেকে ধারনা করা যায়, পাকিস্তানের কিছু অঞ্চলে এভাবে বিদ্যুতায়িত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেওয়ার কুসংস্কার প্রচলিত আছে।
আলোচ্য ছবিতে এভাবেই বিদ্যুতায়িত ব্যক্তিকে সেবা শুশ্রুষা করা হচ্ছিল বলে মনে হচ্ছে।
কবরে অক্ষত ব্যক্তির লাশ : গুজব নাকি বাস্তবতা ?
দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেই খবর পাওয়া যায় যে, ইসলামী রীতিতে কোনো লাশ দাফন করার দীর্ঘসময় পরে নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারনে কবর উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং ভিতরে লাশ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।
এ সকল ক্ষেত্রে পাবলিক ডোমেইনে যেসকল কথিত ‘অক্ষত লাশ’ এর ছবি প্রকাশিত হয়েছে ,সে সকল ছবি অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এগুলো মূলত অক্ষত কাফনের কাপড় এবং অক্ষত কংকালের ছবি। মূল লাশের মাংস – চামড়া অক্ষত অবস্থায় কোথাও দেখা যায়নি।
২০২১ এর জুলাই মাসে ভাইরাল হওয়া কুষ্টিয়ার একটি অক্ষত লাশের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। স্থানীয় একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রত্যক্ষদর্শী মোঃ মুজিবর রহমান ভিডিওতে বলেন, “লাশ উত্তোলনের পরে আমরা দেখলাম, কাফনের কাপড়টা খুব সুন্দর আছে। নষ্ট হয়নি। শরীরের হাড়-হাড্ডি যেমন থাকার কথা, তেমনি সাজানো আছে। মাংস নাই, শুধু হাড় হাড্ডি আছে।“
প্রতিবেদক এ সময় নিজে থেকে প্রশ্ন করেন, লাশটাকে তাহলে অক্ষতই বলা যায় ?
এবং মজিবুর রহমান তখন বলেন, হ্যা, অক্ষতই বলা যায়।
এভাবেই অক্ষত কংকাল কিংবা অক্ষত কাফনের কাপড় এর ঘটনাটা ‘অক্ষত লাশ’ এর গুজবে পরিণত হয়।
দেশ-বিদেশে অক্ষত লাশ আবিষ্কারের গুজবটি বেশ জনপ্রিয় একটি গুজব। মাঝে মাঝেই কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় এ ধরনের কথিত ‘অক্ষত লাশ’ এর গুজব শোনা যায়। তবে পাবলিক ডোমেইনে প্রচারিত তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে এসব দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। আলোচ্য ’৩২ বছর কবরে অক্ষত থাকা লাশ’ এর গুজবটির ও কোনো সত্যতা নেই। প্রকৃতপক্ষে এটি কোনো পুরনো লাশ নয়, বরং সদ্য বিদ্যুতায়িত হওয়া পাকিস্তানের এক ব্যক্তিকে স্থানীয় কবিরাজী রীতিতে চিকিৎসা দেওয়ার ছবি এটা।
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এই সংক্রান্ত পোস্ট গুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে ।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?