সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্ট শেয়ার হয়েছে, এই মর্মে যে, ভারত বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকের এলসি গ্রহণ না করতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে একটি পরিপত্র জারি করেছে। পোস্টগুলোতে শিরোনাম এমন দেয়া হয়েছে যে, বাংলাদেশের দুঃসময়ে সকলপ্রকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করছে ভারত! তবে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন নয়, ডলারের বিপরীতে রুপি ও টাকায় লেনদেন করতে চেয়েছে ইন্ডিয়ান স্টেট ব্যাংক।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন সন্ধান করা হয়। উক্ত বিষয়টির উপরে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে প্রথম আলোতে “রুপি ও টাকায় লেনদেন করতে চায় এসবিআই” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটির বিস্তারিত অংশে বলা হয়েছে, “ভারতের শীর্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক স্টেট ব্যাংক ইন্ডিয়া (এসবিআই) বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক লেনদেনে মার্কিন ডলার ও প্রভাবশালী অন্যান্য মুদ্রা ব্যবহার না করতে সেই দেশের রপ্তানিকারকদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এসব মুদ্রার পরিবর্তে ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশি টাকায় লেনদেন করতে রপ্তানিকারকদের অনুরোধ জানিয়েছে ব্যাংকটি।” প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে নিউজ বাংলা২৪ডটকম “বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা-রুপিতে লেনদেনে ভারতের শীর্ষ ব্যাংকের নির্দেশ” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনটির বিস্তারিত অংশে বলা হয়েছে, “ভারতের রাষ্ট্র খাতের এই ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় থেকে সব শাখায় পাঠানো এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আমদানি খরচ বাড়ায় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রতিবেশী দেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে টাকা ও রুপিতে লেনদেন করলে ঝুঁকি কম হবে। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
উল্লেখ্য, উপরের দুটি প্রতিবেদনই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে রয়টার্সকে সূত্র ধরে এই বিষয়টি উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশের রিজার্ভ চাপে থাকার সময়ে লেনদেনে ঝুঁকি কমাতে সতর্ক এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে এসবিআই এর অভ্যন্তরীণ নথি ও একটি সূত্রের বরাতে একটি বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। রয়টার্সের প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
এখন প্রশ্ন থাকে ভারত ও বাংলাদেশ চাইলেই কি নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাতে পারবে?
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানিতে রুপি-টাকায় লেনদেনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো ব্যাংক থেকে আবেদন বা অনুরোধ আসেনি। তা ছাড়া ভারতীয় মুদ্রা রুপি এখন আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের (এসডিআর) ঝুড়িতে যুক্ত হয়নি। এসডিআর ঝুড়িতে রয়েছে ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড। আইএমএফের সদস্য দেশের মধ্যে সহজে ও নিরাপদ লেনদেনের জন্যই পাঁচটি মুদ্রা-ই স্বীকৃত। ফলে অন্য কোনো মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে বিশেষ নীতি সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হবে।”
অর্থাৎ, এসবিআই বা ইন্ডিয়ান স্টেট ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করলেই টাকা ও রুপিতে লেনদেন সম্ভব না।
স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক:
“স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক, যার ২৫০০০টিরও বেশি শাখা রয়েছে ৩৫টি দেশে। এ ব্যাংকের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৪৬ কোটিরও বেশি এবং এর ব্যালেন্স শিটের আকার ৯০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ব্যাংকটি একটি ফরচুন ৫০০ কোম্পানির তালিকাভুক্ত। বিশ্বের প্রথম ৫০টি ব্যাংকের একটি এবং সম্পদের আকার অনুসারে বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে। এসবিআই বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনায় ৩টি শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে সেবা দিচ্ছে।”
প্রসঙ্গত, এসবিআই ব্যাংক ভারতের অন্যতম একটি বড় ব্যাংক তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়। এই প্রজ্ঞাপনটি যেহেতু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রিজার্ভ ব্যাংক থেকে জারি করা হয়নি, সেক্ষত্রে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের এলসি এসবিআই ব্যাংক গ্রহণ না করলেও ভারতের অন্যান্য ব্যাংক গ্রহণ করতে পারবে। এ বিষয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ দেখে নেয়া যাক:
“নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এ মুহূর্তে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানির এলসি নিষ্পত্তির জন্য এসবিআইর পরিবর্তে অন্যান্য ব্যাংকের সেবা নিতে হবে। তারা জানান, যতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রায় এলসির নিষ্পত্তি করার সুযোগ না দেয়, ততদিন পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বিরাজ করবে। ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাংলাদেশি ব্যাংকগুলো এখন থেকে ঋণপত্রের ক্ষেত্রে ও ব্যাংকের বিদেশি শাখার সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লেনদেনের সুবিধার্থে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে। রুপি ও টাকায় ঋণপত্রের নিষ্পত্তি করার জন্য ২ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একই ধরনের নির্দেশনা দিতে হবে।” পুরো প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
এখানে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানির এলসি নিষ্পত্তির জন্য এসবিআইর পরিবর্তে অন্যান্য ব্যাংকের সাথে লেনদেন করার সুযোগ আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার আবদানি-রপ্তানি বন্ধ হচ্ছে না।
বলাবাহুল্য, এসবিআইয়ের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে সে সময় রয়টার্সকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেনে ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে না এসবিআই। বাংলাদেশের আমদানিকারকদের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ৫০ কোটি ডলার। বাংলাদেশের অর্থনীতি-সংক্রান্ত নানা খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা আর খুব বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে কমিয়ে আনা হবে।”
পুরো বিষয়টার সারমর্ম করলে এমন দাঁড়ায়:
১. এলসি খুলতে বারণ করার সিদ্ধান্ত স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার। এটি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়। ফলে একটি ব্যাংকের সিদ্ধান্তকে গোটা ভারতের সিদ্ধান্ত বলা যায় না।
২. বাংলাদেশের আমদানিকারকদের কাছে ৫০ কোটি ডলার বকেয়া এবং বিদ্যমান ডলার সংকটের প্রেক্ষিতে ডলারের পরিবর্তে টাকা ও রুপিতে লেনদেন করার সাজেশন দিয়েছে ব্যাংকটি। কিন্তু টাকা বা রুপি কোনোটাই আইএমএফ-এর স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের জন্য স্বীকৃত মুদ্রা নয়। ফলে, এসব মুদ্রায় লেনদেন করতে হলে বিশেষ নির্দেশনার দরকার হবে।
বর্তমানে ভাইরাল পোস্টগুলো জনসাধারণের মাঝে যেহেতু এমন বার্তা ছড়িয়েছে যে, বাংলাদেশের সাথে ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সেক্ষেত্রে এ ধরণের পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?