ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতে গুজবের লড়াই: আপনি কী করবেন?

60
ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতে গুজবের লড়াই: আপনি কী করবেন?
ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতে গুজবের লড়াই: আপনি কী করবেন?

Published on: [post_published]

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যকার দীর্ঘ সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় গত ৭ অক্টোবর ২০২৩। সেদিন হামাস এবং ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী নতুন করে আলোচনায় আসে বিষয়টি। আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রথম পাতায় জায়গা পায় ভূরাজনৈতিক এই সংকট। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি নেটিজেনদের ব্যপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় সামাজিক মাধ্যমে। যেকোনো সংকটময় সময়ে তথ্যের পাশাপাশি ব্যপকতা পায় গুজব, ঘৃণা এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।

 

সংকটময় সময়ে গুজবের নানাদিক নিয়ে কথা বলেছেন ড. ভ্যালেরি (Valerie Wirtschafter), ফেলো – বৈদেশিক নীতি , কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং উদীয়মান প্রযুক্তি উদ্যোগ। তিনি বলেন, এই সময়গুলোতে তথ্যের চাহিদা এবং এর ঘাটতির কারণেই বিভিন্ন ধরণের গুজব জায়গা করে নেয়। 

আমরা যদি বাংলাদেশের গুজবের বিষয়বস্তুগুলো পর্যবেক্ষণ করি দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য ছিলো পণ্যবয়কট, ভুল ছবি/ভিডিও ব্যবহার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, এমনকি বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে এই সংঘাতকে যুক্ত করে ভূয়া তথ্য তৈরি। 

 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন ব্যাপকতা এর আগে কোনো সংঘাতে দেখা গিয়েছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেকে দাবি করছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই হবে প্রথম যুদ্ধ, যার অসংখ্য ছবি আমাদের স্মৃতিতে আর্কাইভে থেকে যাবে, অথচ সে ঘটনাগুলো প্রকৃতপক্ষে ঘটেই নি। এর প্রভাব কেমন হবে তা নিয়েও চলছে অনেক কথাবার্তা। 

 

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে এর অধ্যাপক হানি ফরিদ (Hany Farid) বলছেন, ইন্টারনেটে থাকা এসব ডিপফেক এর এক শতাংশও যদি মিথ্যা হয়, তাহলে ইসরায়েল-হামাস ইস্যুতে আমাদের যাবতীয় জানাশোনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এইটুকুই যথেষ্ঠ।  

 

মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ নেটিজেন — প্রায়-সবাই এগুলো ছড়াচ্ছে। ছড়িয়ে পড়া এইসব গুজব বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করছে আমাদের সমাজ এবং চিন্তা ভাবনাকে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কিংবা যুদ্ধের প্রতি আমাদের নৈতিক অবস্থান কেমন হওয়া উচিত এসব কিছুই প্রভাবিত হচ্ছে। পৃথিবীর একেক প্রান্তের মানুষ কেউ ইসরায়েলের হয়ে কিংবা কেউ হামাসের হয়ে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতিতে তথ্যের ভিড়ে গুজব থেকে নিজেকে এবং সমাজকে দূরে রাখার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। 

 

কোনো তথ্যকে সাথে সাথে বিশ্বাস না করে একটু যাচাই বাছাই করে নেয়া দরকার। সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ নেটিজেন সবার জন্যই ন্যুনতম গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা প্রয়োজন। একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ইসরায়েল-হামাসের সংঘাতের সময় যেসব গুজব ছড়াচ্ছে তার বেশিরভাগই ডিসইনফরমেশন বা জেনেশুনে বানানো ভূয়া তথ্য। যারা তৈরি করছেন তারা অনেকেই জেনে বুঝেই করছেন, কিন্তু যারা শেয়ার দিচ্ছেন হতে পারে তারা অনেকেই সত্যিটা জানেন না। তাই সচেতনতা মূলত তাদের জন্যই বেশি প্রয়োজন। 

 

কোনো তথ্য ছড়ানোর আগে কয়েকটি জিনিসের দিকে একটু মনোযোগ দিন। 

 

১) সূত্র যাচাই

 

ক. ক্রস চেক করা

 

অক্টোবরে সংঘাত শুরুর ঠিক একদিন পর ৮ অক্টোবর, ২০২৩ এ একটি ফটোকার্ড সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ডেইলি স্টারের আদলে তৈরি এই ফটোকার্ডে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে একটি উক্তি ছড়ানো হয়। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, তিনি বলেছেন, “আপাতত ফিলিস্তিনের শান্তি রক্ষায় দাবি জানানো আমাদের এজেন্ডায় নেই, আমাদের সকল মনোযোগ এক দফা দাবি আন্দোলনে”। ফটোকার্ডটি যারা শেয়ার করেছেন যদি একটু সময় দিয়ে ডেইলি স্টারের ভ্যারিফাইড পেজটা খুলে দেখতেন তাহলে জানতে পারতেন যে, এটি ভূয়া ফটোকার্ড। অর্থ্যাৎ, কেউ ডেইলি স্টারের নামে তথ্য দিলেই সেটি ডেইলি স্টারের হয়ে যায় না। আমাদের উচিত ক্রস চেক করে নেয়া।

 

খ. একটি সূত্রের উপর ভরসা না-করা

 

৮ অক্টোবর এ দৈনিক কালবেলা থেকে একটি খবর প্রকাশিত হয় যেখানে বলা হচ্ছে, “হামাস আতঙ্ক, দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে ইসরায়েলিদের উপচেপড়া ভিড়”। সেখানে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম গ্লোবস (Globes) এর একটি সংবাদকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গ্লোবসের মূল প্রতিবেদনের তথ্যটি ভিন্ন। সেখানে বলা হয়েছিলো,  যে ৬০ হাজার যাত্রী গত ৮ অক্টোবর ২০২৩ এ ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট (Ben Gurion Airport) দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন তাদের মধ্যে অনেক ইসরায়েলের নাগরিক এবং সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন যারা ছুটিতে বিদেশে অবস্থান শেষে নিজ দেশে ফিরেছেন। অর্থাৎ, ইসরায়েলের নাগরিকরা ইসরায়েল ছাড়ছেন না। বরং, তারা বিদেশ থেকে নিজ দেশে ফিরছেন। 

এমন অবস্থায় আমাদের সবসময় উচিত দ্বিতীয় আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে মূল তথ্যটি যাচাই করে নেয়া। অনেক সময় অনুবাদের জটিলতার কারণেও এমন ভুল হয়ে থাকে। এছাড়াও শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একটি সূত্রের তথ্য গ্রহণ করলে উক্ত বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সঠিক তথ্যের জন্য একাধিক সংবাদমাধ্যম অনুসরণ করাটাই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।

 

গ. লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেয়া

 

ভূরাজনীতির বিভিন্ন ইস্যুতে সংবাদমাধ্যমগুলোকে বিভিন্ন পক্ষ নিতে দেখা যায়। যার প্রভাব তাদের লেখার মধ্যেও পরে। তাই আমাদের উচিত একটু জেনে নেয়া যে, যে সংবাদমাধ্যমের লেখা আমরা পড়ছি — এই নির্দিষ্ট ইস্যুতে তার অবস্থান কি। 

 

২) ছবি এবং ভিডিও যাচাইয়ের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার জানা

 

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই ইস্যুতে অনেক ছবি এবং ভিডিও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। অক্টোবরের শেষের দিকে একটি ছবি পাওয়া যায় যার ক্যাপশনে স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব এথলেটিকো মাদ্রিদকে ধন্যবাদ দেয়া হচ্ছে। কারণ তারা খেলার সময় ফিলিস্তিনের পতাকা প্রদর্শন করেছেন। ছবিতেও দেখা যাচ্ছিলো একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে এমন পতাকা প্রদর্শিত হচ্ছে।ছবি যাচাইয়ের একটি প্রযুক্তি আছে, নাম রিভার্স ইমেজ সার্চ। যেটি ব্যবহার করা খুবই সহজ এবং কার্যকরী। এর মাধ্যমে ছবিটির সূত্র অনুসন্ধান করলেই জানা যেতো যে ছবিটি ফেক বা বানানো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এটি বানানো হয়েছে। 

এমন আরো একটি ঘটনার বিস্তারিত পাবেন এখানে

 

ভিডিওর ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জানাটা জরুরি যে, আসলেই ভিডিওটি কিসের।ভিডিও থেকে স্ক্রিণশট নিয়ে ইমেজ সার্চে খুব সহজেই ভিডিওটি সম্পর্কে জানা যায়।

 

৩) প্রেক্ষাপট

 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কোনো একটি তথ্যের প্রেক্ষাপট। এর উপর তথ্যের সত্যতা অনেকখানি নির্ভর করে। যেমন, ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ছবিতে দাবি করা হয়,  ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আজারবাইজান তাদের আইকনিক টাওয়ারে ইসরায়েলের পতাকার আলোকপ্রদর্শনী করেছে। কিন্তু মূলত ছবিটি প্রায় ৮ বছর আগের। ২০১৫ সালের জুন মাসে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ইউরোপিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় বাকুতে অবস্থিত ফ্লেমস টাওয়ারসে ইউরোপিয়ান গেমসে অংশগ্রহণকারী সব দেশের পতাকার আলোকপ্রদর্শনী হয়। সেই গেমসে ইসরায়েল অংশগ্রহণ করায় তাদের পতাকাও প্রদর্শিত হয়। 

 

অর্থ্যাৎ, ভিন্ন প্রসঙ্গের একটি ছবির মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তাই কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে এর প্রেক্ষাপট জেনে নেয়া জরুরি।

 

গুজব নির্মূল এখন পর্যন্ত প্রায় অসম্ভব একটি প্রক্রিয়া। তবে এর তীব্রতা অনেকাংশেই কমানো যেতে পারে। সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা যদি কোনো একটি গুজব চিহ্নিত করে তা শেয়ার থেকে বিরত থাকে তাহলে এগুলো যারা তৈরি করছে তাদের উদ্দেশ্য অনেকটাই দমে যায়। তাই আমাদের উচিত, কোনো তথ্য শেয়ার করা বা বিশ্বাস করার আগে নিজেদের আবেগকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত রাখা। যুক্তি দিয়ে যাচাই করা যে তথ্যটি কতটুকু সঠিক। বোস্টন ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ফিলোসফি অ্যান্ড হিস্টোরি অব সাইন্সের রিসার্চ ফেলো লি ম্যাকেইন্টায়ার (Lee McIntyre) বলেন, ডিসইনফরমেশন বা অপতথ্য শুধু আমাদের জ্ঞানের ভিত্তিকেই নষ্ট করে না, বরং কোন ব্যক্তি বা মাধ্যমের ওপর আমাদের ভরসার জায়গাটিকেও নষ্ট করে। 

 

তাই তথ্য প্রচার বা প্রকাশের আগে সেটিকে প্রশ্ন করতে হবে। যাচাই-বাছাই করে শুধুমাত্র সঠিক তথ্যটিই আমাদের প্রকাশ করতে হবে। 

 

 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh