যা দাবি করা হচ্ছেঃ গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েল-হামাস সংঘাতকে কেন্দ্র করে আলাদা আলাদা দুইটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, এগুলো ফিলিস্তিনিদের আল–আকসা মসজিদ দখল করার দৃশ্য।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত: দাবিটি বিভ্রান্তিকর। ভিডিওগুলোর সাথে গত ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভিডিও দুইটির মধ্যে একটি হচ্ছে, গত ১৭ এপ্রিল লাইলাতুল কদরে আল-আকসা মসজিদে মুসলমানের জড়ো হওয়ার দৃশ্য। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, قبضة الأحرار (Fist of the Free) নামের ফিলিস্তিনের একটি টিভি সিরিজের অংশ। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে প্রবেশ করে হামলা করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের আল-আকসা দখল করা সংক্রান্ত তথ্য নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম থেকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গত ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার কাছাকাছি ইসরায়েলি অঞ্চলে অতর্কিতে রকেট হামলা চালায় এবং সীমানা পার হয়ে ইসরায়েলি বসতিতে আক্রমণ করে। পাল্টা হামলা হিসেবে ইসরায়েল তাৎক্ষণিকভাবে বিমান হামলা শুরু করে। উভয় পক্ষই এখন একে অপরের উপর আরও বেশি জোরদারভাবে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে আলাদা আলাদা দুটি ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে। এরমধ্যে একটি ভিডিওতে আল আকসার প্রাঙ্গণে সূর্যাস্তের আগে এবং পরে অনেক লোকের ভিড় দেখা যাচ্ছে। এই ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা আছে “আল আকসা মসজিদ দখলে নিয়েছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা।” অপর ভিডিওতে কয়েকজন ফিলিস্তিনি সৈন্যকে একটি ভবনের ছাদে লাগানো ইজরায়েলের পতাকা খুলে ফেলে দিতে দেখা যাচ্ছে। তার বদলে ওখানে ফিলিস্তিনি পতাকা লাগিয়ে আজান দিচ্ছে। এই ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা আছে “ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা আল আকসা দখল করে এর মিনারে উঠে আজান দিচ্ছে”।
তাই এই ভিডিওগুলো আসলে কোন সময়কার, এ ব্যাপারে জানার চেষ্টা করে ফ্যাক্টওয়াচ টিম। এই উদ্দেশ্যে প্রথম ভিডিওটির বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হয়। অনুসন্ধানে, ‘fwaztobasy’ নামের একটি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৮ এপ্রিল আপলোড করা আল আকসার প্রাঙ্গণের সূর্যাস্তের আগের এবং পরের আলাদা আলাদা ভিডিও এবং ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। এই ভিডিওগুলোর সাথে ভাইরাল এই ভিডিওর হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও ভিডিওগুলোর সাথে কোনো ক্যাপশন যুক্ত করা ছিলনা কিন্তু ছবির ক্যাপশনে উল্লেখ করা ছিল যে, এটা গত এপ্রিলে লাইলাতুল কদরের সময় আল আকসা প্রাঙ্গণের দৃশ্য।
এই সূত্র অনুযায়ী প্রাসঙ্গিক কিছু কী-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করা হয়। এতে আন্তর্জাতিক কিছু মূলধারার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। সেখান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, গত ১৭ এপ্রিল মুসলমানরা লাইলাতুল কদরের রাতে প্রার্থনা করার জন্য আল-আকসা মসজিদে জড়ো হয়েছিল। প্রতিবেদনগুলোতে ভাইরাল ভিডিওটির অনুরূপ ছবিও খুঁজে পাওয়া যায়।
এরপর, দ্বিতীয় ভিডিওটির উৎস খুঁজে বের করার জন্যও রিভার্স ইমেজ সার্চ করা হয়। অনুসন্ধানে, ‘quran0’ নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে আপলোড করা ভাইরাল ভিডিওটির অনুরূপ একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওর ক্যাপশন থেকে জানা যায়, এটি ‘Fist of the Free’ সিরিজের একটি ক্লিপ। পরবর্তীতে, সিরিজটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু কী-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করা হয়। অনুসন্ধানে ভিডিও স্ট্রিমিং সাইট ডেইলিমোশনে ‘Fist of the Free’ নামের ৩০ পর্ব বিশিষ্ট সিরিজটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই সিরিজের ৩০ তম পর্বের শেষ পর্যায়ের ৫৫ মিনিট ৩ সেকেন্ড থেকে শেষ পর্যন্ত অংশটুকু ব্যবহার করে দাবি করা হচ্ছে, ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা আল আকসা দখল করে এর মিনারে উঠে আজান দিচ্ছে।
সিরিজটির ৩০ তম পর্বে দেখানো হয়েছে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের অধীনে থাকা একটি কন্ট্রোল টাওয়ার আক্রমণ করে জয়লাভ করে। জয়ের পরে তারা এই টাওয়ারের ছাদে থাকা ইসরায়েলের পতাকা ফেলে দিয়ে ফিলিস্তিনের পতাকা লাগিয়ে আজান দিচ্ছে। ভিডিওর ৪৯ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে হিব্রু ভাষায় লেখা একটি লোগো দেখতে পাওয়া যায় যার সাথে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের লোগোর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভাইরাল এই দৃশ্যটি আল আকসার নয় বরং ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের অধীনে থাকা একটি কন্ট্রোল টাওয়ারের।
অন্যদিকে, জেরুজালেমে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদ বা বায়তুল মুকাদ্দাস মক্কা ও মদিনার পর সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। তবে এই স্থানটিকে ইহুদি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও পবিত্র স্থান বলে মনে করেন। আল-আকসা অনেক আগে থেকেই জর্ডানের অর্থায়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করা একটি ইসলামিক ওয়াকফ বা ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে, নতুন করে আল-আকসা মসজিদকে ফিলিস্তিনিরা দখল করেছে কি না — এ সংক্রান্ত প্রমাণ নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম থেকে পাওয়া যায়নি।
তাই সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া পোষ্টগুলোকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।