বিভিন্ন ধরনের পণ্যের একটি তালিকা বানিয়ে এদের “ইসরায়েলি পণ্য” দাবি করে এসব পণ্য বয়কটের একটি আহ্বান ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে অনুসন্ধানে এসব পণ্যের কোনোটাকেই ‘ইসরাইলি পণ্য’ হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এসব পণ্য কিংবা এদের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কারোই শুরু ইসরায়েলে নয় এবং বর্তমানে কারোরই সদর দপ্তর ইসরায়েলে নেই। তাই এই ১৫ ক্যাটাগরির পণ্যকে “ইসরায়েলি পণ্য” দাবি করে দেয়া পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
এই পোস্টে একটি পোস্টার শেয়ার করা হয়, যেখানে ১৫ টা ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ৩৩টা “ইসরায়েলি” পণ্য এবং এদের বিকল্প পণ্যের তালিকা দেয়া হয়েছে। বাটা, কোকাকোলা, পেপসি , সার্ফ এক্সেল ,পেপসোডেন্ট সহ বেশ কিছু পরিচিত ব্র্যান্ড এখানে দেখা যাচ্ছে। তবে এদেরকে কিসের ভিত্তিতে ‘ইসরায়েলি পণ্য’ বলা হচ্ছে (এদের মূল কারখানার অবস্থান, সদর দপ্তরের অবস্থান, প্রতিষ্ঠা বা অন্যান্য?) তাঁর কোনো ব্যাখ্যা এখানে নেই ।
ইজরাইলি সংবাদমাধ্যম, জেরুজালেম পোস্ট এর এই নিবন্ধে শীর্ষ ১০ টি ইসরাইলী কোম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া উইকিপিডিয়াতে ১৫৫ টা ইসরাইলী ব্র্যান্ডের একটি তালিকা পাওয়া যাচ্ছে। তালিকার প্রথমে রয়েছে আহাভা নামক একটি কসমেটিকস পণ্য , যা ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসরায়েল এর হলন শহরে এর সদর দপ্তর অবস্থিত।) তবে উইকিপিডিয়ার তালিকার কোথাও এই ৩৩ টা ব্র্যান্ডের নাম বা তাদের উৎপাদক কোম্পানির নাম নেই।
এখন তালিকা থেকে প্রতিটা পণ্য ধরে ধরে অনুসন্ধানের চেষ্টা চালানো যাক।
১। জুতা: বাটা
বাটার ওয়েবসাইট থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৮৯৪ সালে চেক প্রজাতন্ত্রে বাটার প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি একটি বহুজাতিক কোম্পানি, এবং এর সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত।
২। শ্যাম্পু: Clear /Sunsilk / Dove
শ্যাম্পুর এই ৩ টা ব্র্যান্ডেরই প্রস্তুতকারক ইউনিলিভার । এটি একটি বহুজাতিক কোম্পানি এবং এর সদর দপ্তর ইংল্যান্ডের লন্ডনে অবস্থিত। ১৯২৯ সালে ইংল্যান্ডের কোম্পানি লিভার ব্রাদার্স ও নেদারল্যান্ডের কোম্পানি মার্গারিন ইউনি একীভূত হয়ে এই ইউনিলিভার গঠিত হয়েছিল।
৩। ওয়াশিং পাউডার: সার্ফ এক্সেল / হুইল/ রিন
এটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান । ১৮৮৬ সালে আমেরিকার নিউজার্সিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং এখনো নিউ জার্সিতেই জনসন এ্যান্ড জনসন এর সদর দপ্তর রয়েছে।
৬। নুডলস: “Meggi”?
এই নামে কোনো নুডলস এর ব্র্যান্ড পাওয়া যায়নি। তবে কাছাকাছি বানানে Maggi নামে একটি জনপ্রিয় নুডলস এর ব্র্যান্ড রয়েছে। ১৮৮৪ সালে জুলিয়াস ম্যাগি নামের একজন উদ্যোক্তা সুইজারল্যান্ডে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে ম্যাগিকে নেসল নামক আরেকটি সুজারল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি কিনে নেয়।
১৮৯২ সালে আমেরিকায় The Coca-Cola Company প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কোম্পানি থেকেই কোকাকোলা, স্প্রাইট ও ফান্টা ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় বাজারজাত করা হয়।
অন্যদিকে ১৮৯৩ সালে আমেরিকায় পেপসিকো কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় , যে কোম্পানির কয়েকটি পণ্য হল পেপসি , সেভেন আপ, এ্যাটম, এ্যাকুয়াফিনা ইত্যাদি।
৮। টয়লেট্রিজ: L’oreal/Boss/Garnier
ল’অরিয়েল ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি ফরাসী কোম্পানি। ফ্রান্সের প্যারিসে এর সদর দফতর অবস্থিত। ল’ অরিয়েল এবং গার্নিয়ার এই কোম্পানির পণ্য।
বস এর প্রতিষ্ঠাতার নাম হিউগো বস। ১৯২৪ সালে জার্মানিতে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানেও এর সদরদপ্তর জার্মানিতে অবস্থিত।
৯। চা: Taaza
ইংল্যান্ডের আর্থার ব্রুক ১৮৪৫ সালে ইংল্যান্ডে Brooke Bond & Company প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ব্রক বন্ডেরই একটি ব্র্যান্ড হল তাজা চা। পরবর্তী সময়ে ব্রুক বন্ড Lipton Teas and Infusions এবং ইউনিলিভার এর সাথে একোভূত হয়ে যায়।
১০। সাবান: Lux/Dove/Lifebuoy
এই ৩ টা পণ্যই ইউনিলিভার এর।
১১। বডি স্প্রে: Axe
এটি ইউনিলিভার এর পণ্য। ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্সে এই ব্র্যান্ড এর বডি স্প্রে বাজারে ছাড়া হয়। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দেশেও এই ব্রাণ্ডের পণ্য বাজারজাত করা হয়।
১২। এন্টি পারসপিরেন্ট: Rexona
রেক্সোনা’র উতপাদক কোম্পানির নাম ছিল Sheldon Drug Company । ১৯০৮ সালে এটা অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে এটি ইউনিলিভার এর সাথে একীভূত হয়ে যায়।
১৩। পাউডার: Pond’s
আমেরিকান ফার্মাসিস্ট Theron T. Pond ১৮৪৬ সালে আমেরিকায় T. T. Pond Company প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানির প্রসাধনী পণ্যসমূহ Pond’s নামে বাজারজাত করা হয়। ১৯৫৫ সালে এটি আরেকটি আমেরিকান কোম্পানি Chesebrough Manufacturing Company এর সাথে একীভূত হয়ে যায়, এবং ১৯৮৭ সালে ইউনিলিভার এর সাথে একীভূত হয়ে যায়।
১৪। টুথপেস্ট: Pepsodent/Close Up
১৯১৫ সালে আমেরিকায় পেপসোডেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪২ সালে এটি ইউনিলিভার কিনে নেয় । আর ক্লোজ আপ এর মূল কোম্পানিই ইউনিলিভার । ১৯৬৭ সালে তারা এই ব্রান্ডের টুথপেস্ট বাজারে ছাড়ে।
১৫। গাড়ি:Ford
এটি আমেরিকান কোম্পানি। ১৯০৩ সালে আমেরিকার মিশিগানের ডেট্রয়েটে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখনো এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় ডেট্রয়েটে অবস্থিত।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে , ১৫টি ক্যাটাগরির ৩৩টা পণ্যের কোনোটার সাথেই ইসরায়েলের দৃশ্যমান কোনো সম্পর্ক নেই, যার আলোকে এদেরকে ইসরায়েলি পণ্য বলা যাবে। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্ট গুলোকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
এ ধরনের পণ্যের তালিকা তৈরি করে “ইসরায়েলি পণ্য” হিসেবে দাবি করার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। ফ্যাক্টক্রিসেন্ডো বাংলাদেশ এর ২০২১ সালের এই প্রতিবেদনে এ ধরনের ৫ টি পণ্যের একটি তালিকা যাচাই করে প্রমাণ করা হয়েছিল যে এগুলো ইসরায়েলের পণ্য নয়। পড়ুন – “কোকা-কোলা, পেপসি, স্প্রাইট…”, এগুলি ইজরায়েলি পণ্য নয়।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।