যা দাবি করা হচ্ছে: দৈনিক কালবেলা কর্তৃক প্রকাশিত একটি ফটোকার্ডে বলা হচ্ছে, “হামাস আতঙ্ক, দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে ইসরায়েলিদের উপচেপড়া ভিড়।” কালবেলা’র মূল সংবাদে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম গ্লোবস (Globes) এর একটি সংবাদকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে উক্ত সংবাদটি প্রকাশ করা হয়েছে।
যা ঘটেছে: ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম “গ্লোবস” এর সংবাদ অনুযায়ী, যে ৬০ হাজার যাত্রী গত ৮ অক্টোবর ২০২৩ এ ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট (Ben Gurion Airport) দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন তাদের মধ্যে অনেক ইসরায়েলের নাগরিক এবং সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন যারা ছুটিতে বিদেশে অবস্থান শেষে নিজ দেশে ফিরেছেন। অর্থাৎ, ইসরায়েলের নাগরিকরা ইসরায়েল ছাড়ছেন না। বরং, তারা বিদেশ থেকে নিজ দেশে ফিরছেন। হামাস আতঙ্কে ইসরায়েলের নাগরিকরা দেশ ছাড়তে এয়ারপোর্টে ভিড় করছেন – এমন সংবাদ কোন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, কালবেলা’র ফটোকার্ড এবং মূল সংবাদে বেন গুরিয়ান এয়ারপোর্টের যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটা প্রায় সাত মাসের পুরানো। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ কালবেলা’র ফটোকার্ডটিতে বিদ্যমান ছবি এবং তথ্যকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।
দৈনিক কালবেলা কর্তৃক প্রকাশিত ফটোকার্ড এবং সংবাদে যে দাবিটি করা হয়েছে তার যথাযথতা যাচাই করতে আমরা কালবেলা’র প্রকাশিত সংবাদটি এবং সেখানে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম গ্লোবস কর্তৃক প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে দেখেছি। দৈনিক কালবেলা ৮ অক্টোবর ২০২৩ এ প্রকাশিত “দেশ ছাড়তে বিমানবন্দরে ইসরায়েলিদের উপচেপড়া ভিড়” শীর্ষক শিরোনামের সংবাদে গ্লোবসকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছে, “গ্লোবসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বেন গুরিয়ান বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ বন্ধ রয়েছে। বিমানবন্দরের ৩ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে। একদিনে এ বিমানবন্দর দিয়ে অন্তত ৬০ হাজার ইসরায়েলি দেশত্যাগ করেছেন।”
Image: Excerpt from the Daily Kalbela
অন্যদিকে, গ্লোবসের যে সংবাদটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেই সংবাদটি অর্থাৎ, ৮ অক্টোবর ২০২৩ এ প্রকাশিত “Ben Gurion airport stays open as foreign airlines cancel flights” শিরোনামের সংবাদটিতে বলা হয়েছে, “At Ben Gurion airport only Terminal 3 is operating and Terminal 1 has been temporarily closed. 60,000 passengers are expected to pass through Ben Gurion airport today, including many Israelis returning home from vacations abroad and soldiers cutting short overseas stays to return to their army units.” লাইনগুলোর বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: “বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্টে টার্মিনাল এক সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে এবং শুধুমাত্র টার্মিনাল তিন সচল রয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, ৬০ হাজার যাত্রী আজ (৮ অক্টোবর, ২০২৩) বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট দিয়ে আসা-যাওয়া করেছেন, যাদের মধ্যে অনেক ইসরায়েলি নাগরিক রয়েছেন যারা বিদেশে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরেছেন এবং বিদেশে অবস্থানরত (ইসরায়েলি) সৈন্যরা তাদের অবস্থানের সময় কমিয়ে দেশে ফিরছেন তাদের নিজ নিজ ইউনিটের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য।”
Image: Excerpt from the Globes news article
এখন, কালবেলা এবং গ্লোবস এর সংবাদ থেকে উদ্ধৃত লাইনগুলোতে আদতে কি বলা হয়েছে তা দেখা যাক। কালবেলা তাদের সংবাদে গ্লোবসকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্টের তিন নাম্বার টার্মিনাল দিয়ে একদিনে অন্তত ৬০ হাজার ইসরায়েলি দেশত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে, গ্লোবসের যে সংবাদটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট দিয়ে যে ৬০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন তাদের মধ্যে অনেক ইসরায়েলের নাগরিক ছিলেন যারা বিদেশ থেকে নিজ দেশে অর্থাৎ, ইসরায়েলে ফিরেছেন। কালবেলা এবং গ্লোবস এর সংবাদ দুটো পড়ে বুঝা যাচ্ছে যে, কালবেলা তাদের সংবাদে গ্লোবসকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করলেও গ্লোবস এর মূল সংবাদের বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি হামাস এবং ইসরায়েলের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ইসরায়েল অভিমুখে তাদের ফ্লাইটগুলো অপসারণ করে ফেলছে। যার ফলে বিদেশে অবস্থানরত ইসরায়েলি নাগরিকরা দেশে ফিরতে পারছেন না। সিবিএস নিউজ, ডেইলি সাবাহ, আরব নিউজ প্রভৃতি সংবাদমাধ্যম মারফত এই তথ্যগুলো জানা গেছে। গ্লোবস এর এই সংবাদে বলা হয়েছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো তাদের ফ্লাইট বাতিল করলেও ইসরায়েলের এয়ারলাইন্সগুলো বিদেশে অবস্থানরত ইসরায়েলি নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে নতুন ফ্লাইট সংযুক্ত করছে। ডেইলি সাবাহ এর একটি সংবাদ অনুযায়ী, ইসরায়েলের পতাকাবাহী এল আল (El Al) এয়ারলাইনস এর একজন মুখপাত্র এএফপিকে বলেছেন, “যেখানে বেশিসংখ্যক ইসরায়েলি নাগরিক নেই সেখান থেকে আমরা ফ্লাইটগুলো বাতিল করে অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত ইসরায়েলি নাগরিকদের সাহায্য করতে পারি।” টাইমস অব ইসরায়েল কর্তৃক প্রকাশিত “Airlines cancel Tel Aviv flights as Israelis abroad scramble for way home” শীর্ষক শিরোনামের এই সংবাদটিতে বলা হয়েছে, “হামাস কর্তৃক বড়-স্কেলের হামলার পর বিভিন্ন মেজর এয়ারলাইন্সগুলো তেল আবিব থেকে এবং তেল আবিব অভিমুখে তাদের ডজনখানেক ফ্লাইট বাতিল করেছে। যার ফলে ইসরায়েলে বেড়াতে আসা পর্যটকরা এয়ারপোর্টে আটকে আছে এবং বিদেশে অবস্থানরত ইসরায়েলিরা দেশে ফিরতে বিভিন্ন এয়ারপোর্টে জড়ো হচ্ছে।” অতএব, গ্লোবস কিংবা এখানে উল্লেখিত অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সংবাদগুলোতে কোথাও বলা হয়নি যে ইসরায়েলের নাগরিকরা দেশ ছাড়তে এয়ারপোর্টে ভিড় করছেন৷ বরং, আমরা বিপরীত চিত্র দেখতে পাচ্ছি। ইসরায়েল অভিমুখে ফ্লাইটগুলো বাতিল হয়ে যাওয়ায় বিদেশে আটকে পড়া ইসরায়েলিরা দেশে ফিরতে পারছেন না এবং ইসরায়েলের এয়ারলাইন্সগুলো নতুন ফ্লাইট সংযুক্ত করে সেইসকল ইসরায়েলিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করছে।
Image: Excerpt from the Times of Israel’s news article
এদিকে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ফটোকার্ডে ব্যবহৃত ছবিটি আদতে বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্টের ছবি কিনা বা ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের কিনা তা যাচাই করতে ঐ ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা গেছে, উক্ত ছবিটি প্রায় সাত মাস আগে তোলা হয়েছে অর্থাৎ, গত ২৭ মার্চ ২০২৩ এ গ্লোবসে প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে ছবিটির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে যে, দৈনিক কালবেলা তাদের ফটোকার্ড এবং সংবাদে গ্লোবসকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করে যে দাবিটি করেছে তা সঠিক নয়। তাছাড়া, ফটোকার্ড এবং মূল সংবাদে যে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে সেটাও পুরানো।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ফটোকার্ডটির দাবিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।