সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি শেয়ার করে দাবি করা হয়েছে, “জাপানে যুদ্ধের সময় এই ছেলেটি তার মৃত ভাইকে কবর দিতে পিঠে নিয়ে যাচ্ছিল। একজন সৈন্য তাকে লক্ষ্য করে এবং তাকে এই মৃত শিশুটিকে ফেলে দিতে বলে যাতে সে ক্লান্ত না হয়। তিনি জবাব দিলেন: সে ভারী নয়, সে আমার ভাই”! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সৈনিকের সাথে শিশুটির কথোপকথনের সপক্ষে কোনো তথ্য-উপাত্ত কোথাও প্রকাশিত হয়নি, বরং উক্ত ছবিটির পিছনে খানিকটা ভিন্ন একটি গল্প রয়েছে।
পোস্টটির বিস্তারিত জানতে ছবিটি নিয়ে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ এর মাধ্যমে অনুসন্ধান করে ইন্ডিয়ান ফ্যাক্টচেকিং সাইট ‘FACTLY’ এর এ বিষয়ে করা একটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে বর্তমান ভাইরাল ছবিটির ক্যাপশনকে বিভ্রান্তিমূলক সাব্যস্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সৈন্যবাহিনী আমেরিকান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। যার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। যুদ্ধের পরে আমেরিকান সৈন্যবাহিনী জাপানের তৎকালীন অবস্থা, ধ্বংসযজ্ঞ, ক্ষয়ক্ষতি, মানুষের জীবনের আমূল পরিবর্তন ইত্যাদির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য কিছু ফটোগ্রাফার নিয়োগ করেন। ইউ.এস মেরিন অফিসার জো ও’ডোনেল ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। যুদ্ধের পরবর্তী সাত মাস জাপানের বিভিন্ন শহর ঘুরে-ঘুরে জো ও’ডোনেল প্রামাণ্যচিত্রের জন্য বেশকিছু ছবি তোলেন। জাপানের নাগাসিকা শহরে তিনি ছবির শিশুটিকে দেখতে পেয়েছিলেন এবং ছবিতে তা ধারণ করেন। ছবিটির আরও বিস্তারিত ইতিহাস জানতে এই প্রতিবেদনটি পড়ুন।
প্রায় এক বছর পরে জো ও’ডোনেল ছবিটির বিষয়ে একজন জাপানি সাংবাদিকের সাথে কথা বলেছিলেন। তিনি জানান, জাপানের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন হৃদয়বিদারক ঘটনা চোখে পড়তো। মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ, ক্ষুধার যাতনা, পরিবেশের চরম বিপর্যয় দেখতে দেখতে তাদের পথ চলতে হতো। এমনই একদিনে জাপানের নাগাসিকা শহরে তিনি শিশুটিকে দেখতে পান। জাপানের রাস্তায় সাধারণত এই বয়সী শিশুরা খেলাধুলায় মেতে থাকতো। তবে এই শিশুটির মাঝে তিনি ভিন্নতা দেখতে পান। শক্ত চোহাল, ভাবলেশহীন অঙ্গভঙ্গিতে খালি পায়ে শিশুটি দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে দড়িতে বাঁধা অন্য একটি শিশুকে সে বহন করছে, শিশুটি যেনো পরম আনন্দে তাঁর পিঠে ঘুমাচ্ছে। মূলত, স্থানটি ছিলো একটি শবদাহ করার শ্মশান। শবদাহ করার জন্য পিঠে বহন করে ছেলেটি তাঁর ছোটো ভাইটিকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তাঁর পালা আসার অপেক্ষায় এখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইকে শবদাহ করে ফিরে যাবে। কিছু সময় পরে শবদাহ করার লোকেরা পিঠের শিশুটিকে নামিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে, ভাবলেশহীন ছেলেটি ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে তা চেয়ে দেখে। কিছুক্ষণ পরে সে ধীর পায়ে ফিরে যায়। জো ও’ডোনেলের সাক্ষাৎকারটি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেখানে পিঠে ভাই বহনকারী বালকটির সাথে জাপানির সৈনের কথোপকথনের কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই।
জাপানের বিভিন্ন শহরে জো ও’ডোনেলের তোলা ছবি এবং সে সকল স্মৃতির উপরে লেখা বইয়ের বিস্তারিত জানতে এই প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
উল্লেখ্য, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে, পোপ ফ্রান্সিস ছবিটি শেয়ার করলে সামাজিক মাধ্যমে ছবিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১লা জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ছবিটি সাথে নিজ হাতের একটি বার্তা জনসাধারণের মাঝে প্রেরণ করেন। অনুবাদ করলে বার্তাটির মানে দাঁড়ায় “যুদ্ধের ফল”
সুতরাং, ১০ বছরের জাপানি বালক ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে কোনো এক সময় তাঁর মৃত ভাইকে কাঁধে নিয়ে শবদাহ করতে শ্মশানে গিয়েছিল। এ বিষয়টি ছবিটির ফটোগ্রাফার জো ও’ডোনেল একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এ কথা সত্য, তবে বালকটির সাথে জাপানি সৈন্যের কোনো কথোপকথনের ঘটনার কথা তিনি বলেননি।
সঙ্গত কারণে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এ সকল পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “আংশিক মিথ্যা” সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?