কাতারে সমকামিতা অবৈধ বলে বিশ্বকাপ খেলবেন না কাভাল্লো – এমন একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, খবরটি সত্য নয়। অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল খেলোয়াড় জশ কাভালো ( Josh Cavallo) এখনো অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পাননি। ফলে তার বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি ভিত্তিহীন। কিন্তু তিনি কাতারের সমকামবিরোধী আইনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কাতারে খেলতে যেতে চান না — এমন কথা একটি অতীতের একটি সাক্ষাৎকারে বললেও সাম্প্রতিক মন্তব্যে তিনি কাতারে তার নিরাপত্তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেন নি, বরং কাতারের যৌন-বৈচিত্র্যের মানুষের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
গুজবের উৎস
যমুনা টেলিভিশনের ফেসবুক পেজে গত ১৫ই অক্টোবর তারিখে রাত ১২ টা ১৪ মিনিটে এই সংবাদটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
এরপর যমুনা টিভিকে উদ্ধৃত করে আরো অনেকেই এই সংবাদটি প্রকাশ করতে থাকে। যেমন দেখুন এখানে , এখানে, এখানে , এখানে ।
যমুনা টিভির এই খবরে বলা হয়, এবারের বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতারে সমকামিতা আইনত অবৈধ। তাই অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পেলেও, কাতার বিশ্বকাপে খেলতে চান না বলে সরে দাঁড়িয়েছেন সমকামী ফুটবলার কাভাল্লো। খবর স্কাই স্পোর্টসের।
পেশাদার ফুটবলারদের মধ্যে সমকামি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন জশ কাভাল্লো।— এবারের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ কাতারের সমকামীদের প্রতি আইনের বিরোধিতা করেন তিনি।
খবরের শেষ অনুচ্ছেদে আবারো বলা হয়, বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন জশ কাভাল্লো। কিন্তু তিনি কাতারের মতো দেশে ফুটবল খেলতে চান না, এমন মন্তব্যে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
জশ কাভালো একজন অস্ট্রেলিয়ান পেশাদার ফুটবলার। ১৯৯৯ এ তার জন্ম। বর্তমান বয়স ২৩ বছর। অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব এ্যাডিলেড ইউনাইটেড এ তিনি সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এবং লেফট ব্যাক হিসেবে খেলেন।
এখনো পর্যন্ত তিনি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পাননি।
ফুটবল বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট গোল ডট কম এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া দলে ডাক পেতে পারেন এমন সম্ভাব্য ৪৭ জনের একটি নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। তবে এই তালিকাতেও জশ কাভালোর নাম নেই।
২০২২ ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দলকে আগামী ১৫ই নভেম্বর এর মধ্যে ২৬ জনের চূড়ান্ত তালিকা পেশ করতে হবে। এর আগে, অক্টোবরের ২১ এর মধ্যে ৫৫ জনের বর্ধিত স্কোয়াড ও জানাতে পারবে দলগুলো, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
যেহেতু জশ কাভালো এখনো বিশ্বকাপ স্কোয়াডে ডাক পাননি, তাই তার বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানোর খবরটি অবান্তর।
বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যম ছাড়া আন্তর্জাতিক কোন সংবাদমাধ্যমে জশ কাভালোর বিশ্বকাপ থেকে সরে দাড়ানোর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
২০২১ সালের নভেম্বরে গার্ডিয়ান পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জশ কাভালো কাতার বিশ্বকাপে খেলার ব্যাপারে নিজের সম্ভাব্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি শুনেছি , কাতারে সমকামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ কথা জানতে পেরে আমি ভীষণ আতংকিত, এবং এই কারণে আমি কাতারে যেতে চাই না। ( I read something along the lines of that [they] give the death penalty for gay people in Qatar, so it’s something I’m very scared [of] and wouldn’t really want to go to Qatar for that )
তিনি আরো বলেন , এই চিন্তা আমাকে হতাশ করে দেয়। এবছর বিশ্বকাপ ফুটবল হচ্ছে কাতারে, এবং একজন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে একজন খেলোয়াড় অবশ্যই ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপে খেলতে চাইবে। কিন্তু যখন জানতে পারবেন খেলা হচ্ছে কাতারে, যারা সমকামী মানুষকে গ্রহণ করে না, তখন এটা আপনার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিবে, তখন আপনাকে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করবে যে আপনার জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ নাকি আপনার ক্যারিয়ার ?
এর প্রতিক্রিয়ায় কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজক কমিটির চিফ এক্সিকিউটিভ নাসের আল খাতের সি এন এন কে বলেছিলেন, আমরা তাকে (জশ কাভালোকে) এখানে স্বাগত জানাই। এমনকি, বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আমরা তাকে স্বাগত জানাই। সবাই এখানে স্বাগত। কেউই এখানে অনিরাপদ নয়।
তিনি আরো যোগ করেন, মানুষ এখানে নিরাপদ বোধ করে না এমন ধারণাটি অসত্য। আমি এটি আগেও বলেছি এবং আমি আপনাকে আবারও বলছি, এখানে সবাইকে স্বাগতম। এখানে সবাইকে স্বাগত জানাই এবং সবাই এখানে নিরাপদ বোধ করবে। কাতার একটি বরণীয় দেশ। এটি একটি অতিথিপরায়ণ দেশ।
নাসের আল খাতের এর এই আশ্বাসের পরে জশ কাভালো কাতারে যেতে আগ্রহী কিনা, এমন প্রশ্নের কোনো সরাসরি উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। তবে গত ১৮ই অক্টোবর সিএনএন এর সাথে ভিন্ন আরেকটি সাক্ষাৎকারে জশ কাভালো বলেন, আমি যদি সেখানে (কাতারে) যাই, তাহলে আমি নিশ্চিত যে আমি নিরাপদ থাকব। কারণ আমি সবার আগ্রহের কেন্দ্রে থাকব। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন তাদের জন্য, যারা (কাতার থেকে) আমাকে মেসেজ করছে । যারা কারো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নয়, যারা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারছে না, আমি তাদের জন্য উদ্বিগ্ন। যখন আমি দেখি যে বিশ্বকাপ এমন এক দেশে আয়োজন করা হয়েছে যেখানে আমাদের মত লোকদের অপরাধী বানানো হচ্ছে, তখন বিষয়টা খুব উদ্বেগের। ( I know personally, if I go there, I will be protected because I’m in the public eye .
But it’s not me that I’m worried about. It’s those ones that are messaging me. It’s those people that aren’t in the public eye that are scared to even be themselves and walk the streets.To see that we’re heading to a country that’s criminalizing people like myself … It’s quite concerning.)
যমুনা টিভির ১৫ই অক্টোবর এর খবরে তথ্যসূত্র হিসেবে স্কাই স্পোর্টস এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, ১৩ই অক্টোবর তারিখে স্কাই স্পোর্টস এ Josh Cavallo: LGBTQ safety should be considered by FIFA when awarding World Cup hosting rights ( বিশ্বকাপ আয়োজনের যোগ্যতা নির্ধারণের সময় এলজিবিটিকিউ (অর্থাৎ লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সচুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার এন্ড কোয়্যার) জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি ফিফার বিবেচনায় নেওয়া উচিত – বলেছেন জশ কাভালো ) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। । এখানে জশ কাভালো নিজের সম্ভাব্য কাতার ভ্রমণের ব্যাপারে কোনো কথাই বলেন নি। তিনি শুধু এখানে বলেছিলেন, “আমি কাতার বিশ্বকাপে এলজিবিটিকিউ ক্রীড়াবিদ এবং ভক্তদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যারা খোলামেলাভাবে, সত্য পরিচয় নিয়ে বাঁচতে পারছে ” কাভালো বলেছেন। ” না। কাতার, এবং ফিফা, বিশ্ব আপনাদের দেখছে । আপনারা কি আমাদের দেখতে পাচ্ছেন?
তিনি আরো বলেন , “আমি ক্রীড়া নেতাদের অনুরোধ করছি বিশ্বকাপ এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতার জন্য আয়োজক দেশ বেছে নেওয়ার সময় আমাদের অধিকার, আমাদের সুরক্ষা বিবেচনা করার জন্য।”
স্কাই স্পোর্টস এর এই প্রতিবেদনেই কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজক কমিটির চিফ এক্সিকিউটিভ নাসের আল খাতের এর বক্তব্য যোগ করা হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, কাতারে যৌন বৈচিত্র্যের মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। কাতার একটি সহনশীল দেশ। এখানে কোনো ধরনের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ঘটনা ঘটবে না।
নাসের আল খাতের আরো জানিয়েছেন, সমকামী দর্শকরা রংধনু রঙের পতাকা বহন করতে পারবে এবং তাদের ভালবাসা প্রকাশ করতে পারবে।
সারমর্ম গত নভেম্বরে জশ কাভালো গার্ডিয়ান এর সাথে সাক্ষাৎকারে কাভালো কাতারে খেলতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানানোর পরে কাতার থেকে তাকে তার নিরাপত্তা বিষয়ে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে সম্ভাব্য কাতার ভ্রমণে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার শংকা দূর হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তিনি কাতারের সমকামী মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে এখনো উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তবে, এখনো পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ স্কোয়াডে কাভালোর নাম পাওয়া যায় নি। সেক্ষেত্রে তিনি খেলোয়াড় হিসেবে কাতার বিশ্বকাপ বর্জন করার অবস্থানে আসেন নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত খবরগুলোকে আংশিক মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?