সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে গ্যাসের সংকটে বিদ্যুত উৎপন্ন হচ্ছে না। অথচ ভারতে এলপিজি গ্যাস রপ্তানি করা হচ্ছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে ভারতে এলপিজি গ্যাস রপ্তানির ব্যাপারে সত্যতা পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই সাথে এটাও জানা গেছে যে, বাংলাদেশে কোন এলপিজি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই। ফলে, এলপিজি গ্যাস দিয়ে বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন সম্ভব নয়। ভাইরাল পোস্টগুলোর দাবির কারণে এমন মনে হতে পারে যে, বাংলাদেশ বিদ্যুত উৎপাদন না করে এলপিজি গ্যাস ভারতে রপ্তানি করছে! সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
গুজবের উৎস
গত ৭ই জুলাই, ২০২২ তারিখ থেকে ফেসবুকে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। ভাইরাল পোস্টে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) লোগো সংবলিত একটি পোস্টারের ছবি আপলোড করা হয়। আপলোড করা ছবি এবং ক্যাপশনে একই ধরনের লেখা দেখতে পাওয়া যায়। ক্যাপশনে লেখা হয়-
“দেশে গ্যাসের সংকটের কারনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না!
অন্যদিকে ভারতে এলপিজি গ্যাস রপ্তানি করা হচ্ছে!
ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন এবং বিএম এনার্জি (বিডি) লিঃ এর মাঝে চুক্তি অনুসারে গত ২৭ জুন ২০২২ তারিখে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এলপিজি রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করে বিএম কোম্পানি।”
গুগল কি-ওয়ার্ড সার্চে ৯ জুন, ২০২২ তারিখে প্রথম আলো প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় বাংলাদেশ ভারতে এলপিজি গ্যাস রপ্তানি করেছে। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ৮২ টন এলপি গ্যাস রপ্তানি করা হয়েছে। ৮ই জুন, ২০২২ তারিখ দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে এলপি গ্যাসবোঝাই পাঁচটি ট্যাংক ত্রিপুরার আগরতলায় ঢোকে। এর আগে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ওমেরা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড গত ৩১ মে দুটি ট্যাংকে করে প্রথমবারের মতো আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে প্রায় ৩৫ টন এলপি গ্যাস ভারতে রপ্তানি করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মোট ১১৭ টন এলপি গ্যাস রপ্তানি করা হয়।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোর চাহিদা মেটাতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানিকৃত এসব এলপিজি গ্যাস বাংলাদেশে প্রক্রিয়াজাত করে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের ত্রিপুরা রাজ্যের বিশালগড়ের এলপিজি প্লান্টে সরবরাহ করা হয় বলে জানা যায় যুগান্তরের এই রিপোর্টে।
২০১৯ সালে ভারতের ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানি বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। সে সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ‘’ভারতে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরাতে এলপিজি পৌঁছতে সড়ক পথে ১৫০০ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিতে হবে। আর বাংলাদেশ থেকে সেখানে স্বল্প পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছানো সম্ভব। এই চুক্তির ফলে ভারত যেমন তার বিশাল দূরত্বের খরচ থেকে বাঁচবে। আবার বিদেশ থেকে এনে বোতলজাত করে গ্যাস রপ্তানির ফলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও পরিবহন খাতে ব্যস্ততায় এখানে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যও বাড়বে।”
ভাইরাল পোস্টের তথ্যমতে বাংলাদেশ যে ভারতে এলপি গ্যাস রপ্তানি করেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এলপি গ্যাস বনাম প্রাকৃতিক গ্যাস
প্রাকৃতিক গ্যাস হচ্ছে একধরণের জীবাশ্ম জালানী যেগুলো ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসে নানা রকম উপাদান থাকতে পারে তবে সব থেকে বেশি পরিমাণে থাকে মিথেন। প্রাকৃতিক গ্যাসে অল্প পরিমাণে এনজিএল বা ন্যাচারাল গ্যাস লিকুইড (মিথেন, প্রোপেন, বিউটেন, আইসোবিউটেন, ইথেন, ইথিন, প্রোপেন, আইসোবিউটিন, বিউটাডিন, পেনটেন, পেন্টিন এবং পেন্টেনস প্লাস) এবং ননহাইড্রোকার্বন গ্যাস (কার্বন ডাই অক্সাইড, জলীয় বাষ্প) থাকে।
উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে গ্যাসচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস পুড়িয়ে বিদ্যুত উৎপন্ন করে। প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক এইসব বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ বিদ্যুতের যোগান দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি প্রোপেন, বিউটেন বা এই দুইটার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। এলপি গ্যাস মূলত অপরিশোধিত তেল রিফাইনিং করার সময় পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের ইস্টার্ন রিফাইনারি কোম্পানি লিমিটেডে বিদেশ থেকে ক্রুড অয়েল আমদানি করে এখানে পরিশোধন করে এলপিজি সহ ১৬ রকম পেট্রোলিয়াম দ্রব্য উৎপাদন করা হয়।
এছাড়া বিদেশ থেকেও সরাসরি এলপিজি আমদানি করে বাংলাদেশ।
এলপি গ্যাসে অনেক বেশি পরিমাণে জ্বালানির প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেই তুলনায় অনেক কম শক্তি উৎপন্ন হয়। সংরক্ষণেও বাড়তি ব্যবস্থাপনার দরকার হয়। এসব অসুবিধার কারণে এলপি গ্যাস দিয়ে সাধারনত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় না।
তবে বর্তমানে বৈশ্বিক বিদ্যুতের চাহিদা মাথায় রেখে এলপিজি গ্যাস দিয়েও বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিছু বিদ্যুত কোম্পানী খুব অল্প পরিমাণে বিদ্যুত উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। তবে তা একটা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে খুবই নগণ্য।
SoEnergy কোম্পানী প্রথম এলপিজি ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরি করেছে।
তবে বাংলাদেশে এলপিজি ভিত্তিক কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎ-কেন্দ্র আছে তার সবগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ থেকে দেখুন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের তালিকা।
১৩ মে, ২০১৮ তারিখে সমকালে প্রকাশিত একটা সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রায় দেশের প্রথম এলপিজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হবে ৪৫০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটি স্থাপন করবে নৌ-কল্যাণ ফাউন্ডেশন ট্রেডিং কোম্পানি (এনকেএফটিসিএল)।
তবে এরপর থেকে এলপিজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের আর কোন সংবাদ ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়নি।
তাই এটা স্পষ্ট বাংলাদেশে কোন এলপিজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নেই।
সারমর্ম
ফেসবুকে ভাইরাল পোস্টগুলোর সারমর্ম ছিলো বাংলাদেশে গ্যাস সংকটের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই ভারতে এলপি গ্যাস রপ্তানি না করে এগুলো দিয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলা করা যেত।
কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু কোন এলপিজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নেই তাই এলপি গ্যাস দিয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
যেহেতু বাংলাদেশে এলপি গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়না তাই ফ্যাক্ট ওয়াচ পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।