১৯৭১ সালের এই ছবিটা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নয়

33
১৯৭১ সালের এই ছবিটা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নয় ১৯৭১ সালের এই ছবিটা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নয়

Published on: [post_published]

১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত দেলু রাজাকার ওরফে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’র ছবি দাবিতে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের সাবেক নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (১৯৪০-২০২৩) নন, বরং ভিন্ন কোনো ব্যক্তি । এই ব্যক্তির নাম জানা না গেলেও একাধিক উৎস থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর এই লোকটিকে বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আনা হয়, এবং তাৎক্ষণিকভাবে গণ আদালত বসিয়ে উপস্থিত জনতার রায় গ্রহণ করে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ, ছবির এই লোকটি ১৯৭১ সালেই নিহত হয়েছেন, ২০২৩ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন না। কাজেই তিনি যুদ্ধাপরাধের জন্য সাজাপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নন।

গুজবের উৎস

ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে


ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান

আলোচিত ছবির উপরের অংশে ক্যাপশনের মত করে লেখা রয়েছে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ছবি।মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী কর্তৃক পিরোজপুরে আটককৃত রাজাকার দেলু সিকদার।(বর্তমান দেলোয়ার হোসেন সাঈদী) ও তার দলের অন্যান্য সদস্যরা ওই মুহূর্তে রাজাকার দেলু সিকদার এর চুলের মুঠি ধরে রাখেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।

মূল ছবির নিচে ডান পাশে লেখা রয়েছে দৈনিক সংবাদ , ২৩/১২/১৯৭১

আরো নিচে এক বাক্যে কিছু লেখা থাকলেও তার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।

রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মূল ছবিটা খোঁজার চেষ্টা করলে, সংগ্রামের নোটবুক নামক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ওয়েবসাইটের একটি পাতায় এই ছবিটা পাওয়া যায়। ছবিটার উপরে getty images এবং William Lovelace কথাগুলো থাকায় আমরা এই সূত্র ধরে অনুসন্ধান শুরু করি।

ছবি আদান প্রদানের ওয়েবসাইট গেটি ইমেজ এ উইলিয়াম লাভলেস এর ৮৫৯ টি ছবি রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-কেন্দ্রিক ছবিগুলোর মধ্যে আলোচ্য ছবিটা খুঁজে পাওয়া যায়।

আলোচ্য ছবির ক্যাপশন ছিল – Prisoners’ Last Moments

ছবির বিবরণে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা রাজাকার সন্দেহে আটক ৪ ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে । এই ৪ জনের মধ্যে ৩ জনকে বেয়নেট চার্জ করে খুন করেন মুক্তি বাহিনী নেতা আব্দুল কাদের সিদ্দিকী।

প্রায় কাছাকাছি ধরণের ছবি পাওয়া যাচ্ছে ছবি শেয়ারের আরেকটি ওয়েবসাইট alamy তে । এখানে Penny Tweedie নামক একজন কন্ট্রিবিউটর The infamous bayonetting of 5 young men during Bengali victory rally Dacca Stadium Dec 18 শিরোনামে  বেশ কয়েকটি ছবি আপলোড করেছেন।

এই ছবিগুলোর সাথে পূর্বোক্ত গেটি ইমেজ এর ছবিগুলোর মিল পাওয়া যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পূর্বোক্ত উইলিয়াম লাভলেস এবং পেনি টুইডি একই সময়ে কাছাকাছি জায়গায় থেকে ভিন্ন ভিন্ন ডিভাইস দিয়ে ছবিগুলো তুলেছিলেন।

সংগ্রামের নোটবুক ওয়েবসাইটে ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১ ঃ কাদেরিয়া বাহিনীর হটকারী কার্যক্রম শিরোনামে এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, পল্টন ময়দানে জনসভা শেষ হওয়ার পর কাদের সিদ্দিকী ৫ বিহারী রাজাকার বা সন্ত্রাসীর বিচারে সাজা কার্যকর করেন। উপস্থিত ডজন খানেক বিদেশী সাংবাদিকদের সামনেই তাদের হত্যা করা হয়। ———- কাদের সিদ্দিকী পরে তার প্রকাশিত বই স্বাধীনতা ৭১ এ লিখেছেন, তাদের গাড়ি যখন পল্টনে মোড় নিয়েছে এমন সময় বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুটো ডাটসান গাড়ির ভেতর থেকে কিশোরী কণ্ঠে আর্তচিৎকার শোনেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দুটো ঘিরে ফেলে মুক্তিবাহিনীর অন্য সদস্যরা। দুজন যুবক দৌড়ে পালায়, ধরা পড়ে চার জন। ভীত সন্তস্ত্র কিশোরী দু’জনের কাছে যা জানা গেল, তারা অবাঙ্গালী। এই ছয়জন তাদের বাসায় লুটপাট চালিয়ে, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও দু বোনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, আর তাদের বৃদ্ধ মোটর মেকানিক পিতাকে বেঁধে রাখা হয়েছে গাড়ির পেছনের বনেটে। ঠিকই দেখা যায় সত্যি বলছে মেয়েরা।

এরপর দুষ্কৃতিকারী ৪(৫) জনকে জনসমুদ্রে পরিণত হওয়া স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সদ্য স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে নিয়ে বক্তব্য রাখেন কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান এবং মঞ্চে তোলা হয় মেয়ে দুটোকে। তাদের বক্তব্য শোনার পর, জনতার কাছে রায় চাওয়া হয়- তারা সমস্বরে দাবি জানান মৃত্যুদণ্ডের। পরে চারজনকে একটি করে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে শাস্তি কার্যকর করে কাদেরিয়া বাহিনী।

১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস এর আর্কাইভে 4 Tortured, Slain at Dacca Rally শিরোনামে একই ঘটনার কথা জানা যায়। এখানে কোনো ছবি নেই, এবং ৪ জনকে আটক করার এবং জনগণের রায় নেওয়ার কোনো বিবরণ নাই। তবে বাদবাকি অংশ ( বেয়নেট চার্জ করে ৪ জনের মৃত্যু) এর বিবরণ গেটি ইমেজ এবং সংগ্রামের নোটবুক থেকে প্রাপ্ত বিবরণের সাথে মিলে যায়।

তবে কোনো পোস্টেই উক্ত ৪ বা ৫ ব্যক্তির নাম,পরিচয় বা সনাক্তকারী কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে এখানে ধরে আনা কোনো রাজাকারই প্রাণে বেঁচে যেতে পারেন নি, এ বিষয়টি সবগুলো সূত্র নিশ্চিত করছে। সে হিসেবে এই ছবির কারো পক্ষে “দেলু রাজাকার” কিংবা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী হওয়া সম্ভব নয়।

ভাইরাল ফেসবুক আরো পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, আলোচিত ছবিটি ১৯৭১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তবে বাংলাপিডিয়ার এই ভুক্তি থেকে জানা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয় নি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি থেকে পুনরায় এর প্রকাশনা শুরু হয়।

অর্থাৎ, ১৯৭১ সালের ২৩শে ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ এর কোনো সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি । অতএব সেদিনের পত্রিকায় আলোচ্য ছবি থাকার দাবিটি ভিত্তিহীন।

সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে ।

সংযোজনীঃ “জামায়াতের সাবেক আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (১৯৪০-২০২৩) নন, বরং ভিন্ন কোনো ব্যক্তি”- লাইনটি পরিবর্তন করে “নায়েবে আমির” শব্দ দুইটি যুক্ত করা হয়েছে। 

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

No Factcheck schema data available.