মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা NASA ২৪ জন ধর্মযাজককে চাকরি দিয়েছে, এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে এলিয়েন (ভিনগ্রহবাসী) খোঁজার চেষ্টা করছে- এমন একটি খবর ভাইরাল হয়েছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, পুরনো একটি খবর বর্তমানে বিকৃতভাবে ছড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে NASA ২০১৫ সালে CTI নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে গবেষণার জন্য আর্থিক অনুদান দিয়েছিল। সেই গবেষণায় CTI ২৪ জন ধর্মতাত্ত্বিককে নিয়োগ দিয়েছিল বহির্বিশ্ব সম্পর্কে গবেষণার সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে জানার জন্য। NASA সরাসরি কাউকে নিয়োগ দেয়নি, নিয়োগকৃত ধর্মতাত্ত্বিকদের নিয়ে ‘এলিয়েন খোঁজা’র মত কোনো কাজ করা হয়নি এবং এই গবেষণা ২০১৭ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
গুজবের উৎস
ইংল্যান্ডভিত্তিক ইউকে টাইমস এবং ডেইলি মেইল এর ২৪শে ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন কে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজবের সূত্রপাত হয়েছে বলে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে।
বাংলা ভাষায় গত ২৭শে ডিসেম্বর ‘ঢাকা টাইমস’ পত্রিকায় এ বিষয়ক সংবাদের শিরোনাম ছিল – এলিয়েন খুঁজতে ধর্মযাজকদের নিয়ে মহাকাশে নাসা । নিজেদের ফেসবুক পেজে এই খবর এর ক্যাপশনে ঢাকা টাইমস উল্লেখ করেছে- নাসা ২৪ জন বিভিন্ন ধর্মের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নিজেদের এলিয়েন হান্টিং মিশন করবে ।
একই ধরনের চটকদার শিরোনামযুক্ত খবর বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই দেখা গিয়েছে। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।
এলিয়ানদের কাছে এই মহাবিশ্বটা ঠিক কেমন? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষজনই বা এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি কী ভাবে দেখবে? এই সব দিক সুচারু ভাবে বিশ্লেষণের জন্য প্রায় ২৪ জন ধর্মতাত্ত্বিক নিয়োগ করতে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা। ধর্মতাত্ত্বিক শব্দটা খটমট মনে হলে পাতি কথায় বলা যেতে পারে পুরোহিত। ইতিমধ্যেই কাজটি শুরু করে দিয়েছে নাসা। একজন ব্রিটিশ যাজককে নিয়োগও করা হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার প্রিস্টনে সেন্টার ফর টেকনোলজিক্যাল এনকোয়্যারি ও নাসার যৌথ উদ্যোগেই সম্পন্ন হবে এই রিসার্চ ওয়ার্ক।
ডেইলি মেলের একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, আপাতত ব্রিটেনের ধর্মতত্ত্ববিদ রেভারেন্ড ডক্টর অ্যান্ড্রু ডেভিডসনকে (Rev Dr Andrew Davidson) নিয়োগ করা হয়েছে এই কাজের জন্য। প্রাথমিক ভাবে তাঁর কাজ হবে, মানুষ এবং এলিয়নদের মধ্যে কী সম্পর্কে রয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাই বী কী কী, এই সব কিছু খতিয়ে দেখা। এই প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য হল, এলিয়েনদের সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য খুঁজে সেগুলি এককাট্টা করা। সেই তালিকায় থাকবে একাধিক বিষয়। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বের প্রধান ধর্মগুলি বহির্জাগতিক জগৎের প্রাণ সম্পর্কে কী মনে করে। মানুষের মতোই সংবেদনশীল জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে কি না, সে দিকটাও তুলে ধরবে এই প্রকল্প।
লক্ষণীয় , এসব খবরে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কাল ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে, এই খবর পাঠ করে একজন পাঠক ভাবতে পারেন, নিকট অতীতে NASA এসকল পুরোহিতদের চাকরি দিয়েছেন, কিংবা অদূর ভবিষ্যতে চাকরি দেবেন । যেমন – প্রথম কোলকাতা জানাচ্ছে, নাসায় আপাতত প্রায় ২৪ জন পুরোহিতকে নিযুক্ত করা হবে। এই পুরোহিত কিংবা ধর্মতত্ত্ববিদের কাছ থেকে নাসা সর্বদা জানার চেষ্টা করবে , এলিয়েন সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের ধারণা।
এছাড়া, এ সকল খবরে CTI এর সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ না করে সরাসরি ‘নাসা পুরোহিত নিয়োগ করেছে’ বলে দাবি করা হচ্ছে।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান
গুজবটি ভাইরাল হওয়ার পরে ইতিমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং সংবাদমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানাচ্ছেন, ভাইরাল হওয়া এই খবরটি মিথ্যা। এমন কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে- এপি , ইউএসএ টুডে , mahoningmatters ইত্যাদি ।
NASA’র একজন কর্মকর্তা এপি নিউজকে জানিয়েছেন, Center of Theological Inquiry, Princeton, New Jersey কে একটি গবেষণা প্রকল্পের জন্য ২০১৫ সালে নাসা অর্থায়ন করেছিল। নাসা একা নয়, John Templeton Foundation নামক অন্য একটি সংস্থাও এই অর্থায়নে যুক্ত ছিল। গবেষণা প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, আধুনিক জ্যোতির্জীববিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার এর সামাজিক প্রভাব ( SOCIETAL IMPLICATIONS OF ASTROBIOLOGY) ২০১৭ সালেই নাসার এই প্রকল্পে নাসার অর্থায়নের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
ইউএসএ টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে নাসা’র সিনিয়র সায়েন্স কমুনিকেশন ডিরেক্টর Karen Fox জানিয়েছেন, যেসকল ধর্মতত্ত্ববিদকে এই প্রকল্পে এসেছেন,তাদেরকে নাসা নির্বাচন করেননি। একইসাথে এরা নাসার সাথে গবেষণা,চাকরি কিংবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না। এরা স্বাধীনভাবে CTI তে চাকরি করেছেন , এবং তাদেরকে NASA এর কর্মচারী বলা যাবে না।
অন্যদিকে , CTI এর পরিচালক William Storrar সংবাদমাধ্যম এপি কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের এই কর্মসূচি নাসাকে উপদেশ দেওয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়নি। বরং এর উদ্দেশ্য ছিল মানবিক (Humanities) বিভাগের গবেষকদের এ্যাস্ট্রোবাইয়োলজি সম্পর্কিত আলোচনাগুলাকে একত্রিত করা। এই প্রকল্পের অধীনে কয়েক বছরে বিভিন্ন দার্শনিক, সাহিত্যিক, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং রিলিজিয়াস স্কলারদের বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ একটি সিরিজ আকারে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষণা প্রকল্পের সাবেক ফেলো, Dr Andrew Davison সম্প্রতি Astrobiology and Christian Doctrine নামে একটি বই প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পর থেকেই ২০১৫ সাল নাসার অর্থায়নের পুরনো খবরটি সামনে চলে আসে এবং অনলাইন ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিকৃতভাবে খবরটি ভাইরাল হয়।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
নাসা সরাসরি কোনো ধরনের পুরোহিত কিংবা ধর্মতত্ত্ববিদ সম্প্রতি নিয়োগ করেনি। ৬ বছর আগে অন্য একটি গবেষণা প্রকল্পের একটি অংশে নাসা অর্থায়ন করেছিল, যে প্রকল্পে ২৪ জন ধর্মতত্ত্ববিদ ও অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রকল্পে এলিয়েন অনুসন্ধান করা কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সম্ভাব্য এলিয়েন এবং বহির্জাগতিক বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মানুষের সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণাই ছিল এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য । সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত গুজবগুলোকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?