সম্প্রতি তীব্র তাপদাহে মানুষ যখন অতিষ্ঠ তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, ‘NASA জানিয়েছেন,আগামী ২৫মে থেকে শুরু হবে নওতাপ। এই সময় সূর্য যেন আগুন ছড়াতে শুরু করবে পৃথিবীর বুকে। সূর্য প্রতি বছর যে সময় রোহিণী নক্ষত্রে অবস্থান করে, সেই সময়টায় সবেচেয়ে বেশি গরম পড়ে।’
উক্ত প্রতিবেদনে জ্যোতিষীদের বরাত দিয়ে বলা হয় যে আগামী ২৫ মে থেকে শুরু হবে নওতাপ। এই সময় সূর্য যেন আগুন ছড়াতে শুরু করবে পৃথিবীর বুকে। সূর্য প্রতি বছর যে সময় রোহিণী নক্ষত্রে অবস্থান করে, সেই সময়টায় সবেচেয়ে বেশি গরম পড়ে। আগামী ২৫ মে সকাল ৩টে ১৬ মিনিটে সূর্য রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করবে। ১৫ দিন রোহিণী নক্ষত্রে অবস্থান করে মৃগশিরা নক্ষত্রে গোচর করবে সূর্য। রোহিণী নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থানের এই ১৫ দিন সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ হয়। সূর্য রোহিণী নক্ষত্রে ১৫ দিন থাকলেও তার মধ্যে প্রথম ৯ দিন গরম সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই ৯ দিনকে নওতাপ বলা হয়। এই বছর নওতাপ চলবে আগামী ২৫ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত।
নওতাপের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার নিয়ে উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় “বৈদিক পঞ্জিকা অনুসারে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের গোড়াতেই শুরু হয় নওতাপ। প্রতি বছর এই সময় তাপমাত্রা থাকে সবচেয়ে বেশি। সূর্যের আগুনে হলকায় যে জ্বলে পুড়ে যায় চারদিক। শুধু জ্যোতিষ গণনা অনুসারে নয়, নওতাপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। রোহিণী নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থানকালের প্রথম নয় দিন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে কমে আসে। নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে এই সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ সূর্যের সবচেয়ে নিকটে চলে আসায় এই নয় দিন তীব্র গরম অনুভূত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে এই নয় দিনকেই নওতাপ বলা হচ্ছে। এই সময় সূর্য কিরণ সরাসরি পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এসে পড়ে।”
উক্ত প্রতিবেদনে নওতাপের সময় সূর্যদেবের আরাধনা করার কথাও বলা হয়েছে।
নওতাপ নিয়ে ভারতের প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলো অনেক খবর প্রচার করেছে। ভারতের News 18 এর ২৬ এপ্রিল প্রকাশিত অনলাইন সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে নওতাপ ৯ দিনের একটি মৌসুম। নওতাপের এই ৯ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এটি সনাতন ধর্মালম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে এই সময়টা সূর্য দেবতাকে ভক্তি করার সময়।
হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নওতাপ শুরু হয় জেঠ মাসের শুরুতে এবং এটি ১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই ১৫ দিনের ভিতর প্রথম ৯ দিন তীব্র গরম পড়ে। একারণে এটিকে নওতাপ বলে।
১৭ই মে, ২০২৩ তারিখে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম Times Now News থেকে নওতাপের সংজ্ঞা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, ‘নওতাপ’ অর্থ তীব্র গরমের নয় দিন। ‘নওতাপ’ শুরু হয় যখন সূর্যদেব ১৫ দিনের জন্য রোহিণী নক্ষত্রে প্রবেশ করেন। এই ১৫ দিনের মধ্যে প্রথম ৯ দিনকে গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে উষ্ণ বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, সূর্য যখন জৈষ্ঠ মাসে রোহিণী নক্ষত্রে থাকে, তখন সূর্যের রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পড়ে, যার ফলে সেই দিনগুলোতে তীব্র গরম হয়। ২০২৩ সালের নওতাপ সংগঠিত হয় ২২ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত।
অতএব ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে নওতাপ শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং জ্যোতিষ গণনার ফল। এর সাথে বিজ্ঞানের কোন যোগসূত্র নেই। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের অফিশিয়াল কোন মাধ্যম থেকে নওতাপ নিয়ে কোন বিবৃতি দেয়নি।
নওতাপের সময় সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্ব কি কম থাকে?
এই সময় এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নওতাপের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। রোহিণী নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থানকালের প্রথম নয় দিন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে কমে আসে। নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে এই সময় পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ সূর্যের সবচেয়ে নিকটে চলে আসায় এই নয় দিন তীব্র গরম অনুভূত হয়। জ্যোতিষশাস্ত্রে এই নয় দিনকেই নওতাপ বলা হচ্ছে।
অর্থাৎ, এই পোস্টে দাবি করছে, নওতাপের সময় (২৫ মে-২ জুন) সূর্য এবং পৃথিবীর দূরত্ব সবচেয়ে কম থাকে।
তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে এই দাবিটা ভুল। পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, তাই সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব একেক সময়ে একেক রকম হয়। সর্বনিম্ন দূরত্বকে বলা হয় পেরিহেলিওন (Perihelion) বা বাংলায় অনুসূর , আর সর্বোচ্চ দূরত্বকে বলা হয় এ্যাপহেলিয়ন (Aphelion) বা অপসূর । প্রতিবছর জানুয়ারির প্রথম দিকে পেরিহেলিয়ন/অনুসূর , এবং জুলাই এর প্রথম দিকে এ্যাপহেলিয়ন/অপসূর অনুষ্ঠিত হয়।
টাইম এন্ড ডেট ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩রা জানুয়ারি সকাল ৬ টা ৩৮ মিনিটে সূর্যের সাথে পৃথিবীর সর্বনিম্ন দূরত্ব ছিল ১৪,৭১,০০৬৩২ কিলোমিটার, যা এই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অন্যদিকে, এবছর ৫ই জুলাই সকাল ১১টা ৬ মিনিটে সূর্যের সাথে দূরত্ব বেড়ে দাঁড়াবে ১৫,২০,৯৯,৯৬৮ কিলোমিটার, যা এই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দূরত্ব।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, নওতাপের সময় সূর্য সর্বনিম্ন দূরত্বে অবস্থান করবে না, বরং নওতাপ এর কাছাকাছি সময়ে সূর্য পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করবে।
নওতাপকিআসলেইউষ্ণতমসময়?
২৫ মে, ২০২২ তারিখে দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া একটি সংবাদ প্রচার করে যার শিরোনাম ছিলো ‘আবহাওয়া অফিস বলেছে নওতাপ আর মৌসুমের সব থেকে উষ্ণতম দিনগুলো হবে না’। মূল সংবাদে বলা হয়েছে ভূপাল সার্কেলের মেট অফিশিয়ালরা জানিয়েছেন প্রাক-বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে নওতাপ এ আসলে কম গরম অনুভূত হবে। নওতাপ ২৫ মে থেকে শুরু হবে, কিন্তু ভূপাল রাজ্যে ওই বছরে ১০ মে থেকে ১৫ই মে পর্যন্ত সর্বোচ্চ উষ্ণতম সময় রেকর্ড করা হয়। ভূপালে ১৩ই মে ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যা ভূপালে ওই মৌসুমে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল এবং কোন কোন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছিলো। মেট অফিশিয়ালরা বলেন বিগত বহু বছরের আবহাওয়ার প্যাটার্ন অনুসরণ করলে এটি লক্ষ্য করা গেছে যে নওতাপের সময় তাপমাত্রা আসলে কমতে শুরু করছে। এই বছরের জন্য তাপমাত্রা শীর্ষ অবস্থানে চলে গেছে এবং তাপমাত্রা এর থেকে বেশি আর বাড়বে না, প্রাক-মৌসুমি আবহাওয়ার কারণে আর্দ্র পরিস্থিতি বর্ষা না আসা পর্যন্ত বাসিন্দাদের অস্বস্তিতে রাখবে।
বাংলাদেশে নওতাপ এর গুজব নিয়ে ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আজকের পত্রিকা এবং রিউমার স্ক্যানার। এখানেও তারা জানাচ্ছে, এই সময়ে সর্বোচ্চ গরম পড়ার কোনো ভিত্তি নেই।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
অতএব ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে নওতাপ একটি হিন্দু ধর্মীয় এবং জ্যোতিষ গণনা প্রথা। এটি প্রতিবছর পালন করা হয় সূর্যদেবতার আরাধনার জন্য। এর সাথে বিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। এলাকাভেদে আবহাওয়া আলাদা হয়। কখনো কখনো নওতাপের সময় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তাছাড়া নাসা নওতাপ সম্পর্কে কোন বিবৃতি দেয়নি। কোন সংবাদ মাধ্যমেও এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।