চাঁদের মাটিতে প্রথম পা-রাখা নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং কে নিয়ে একটি বেশ কিছু ভুল দাবি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে । এখানে দাবি করা হচ্ছে, নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে আজানের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই গুজবটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। নিল আর্মস্ট্রং নিজেও এই দাবিটি অস্বীকার করেছিলেন।
এই ভিডিওতে মিজানুর রহমান আজহারিকে বলতে শোনা যায় , নিল আর্মস্ট্রং খেয়াল করে দেখে, চাঁদের এই মাথা থেকে ওই মাথা মাঝখান থেকে ফাটা।—— সে পরবর্তীতে পৃথিবীতে এসে বিশ্বনবীর বায়োগ্রাফি পড়ে জানতে পেরেছে ,এটা বিশ্বনবী আঙুলের ইশারায় ফাটিয়েছিলেন।—– আবার চাঁদের মধ্যে সে একটা মিউজিক শুনতে পেল। কিন্তু পৃথিবীতে এসে কোথাও এই মিউজিক সে পায়না। —পরে ,আমেরিকার এক প্রেয়ার হলের পাশ দিয়ে সে হেটে যাচ্ছে, হঠাত দেখে মসজিদের ভেতর থেকে ওই মিউজিক টা বাজে,যেটা সে চাঁদে শুনেছে। মসজিদের ভিতরে ঢুকে দেখে, এক লোক কানের মধ্যে ২ হাত দিয়ে এই মিউজিকটা বাজায়। আসলে এটা মিউজিক না আজান ? ( উপস্থিত জনতা বললেন, আজান)—সে ভিতরে ঢুকে মুয়াজ্জিনরে বলে, তুমি এত বড় সিঙ্গার, এত বড় মিউজিশিয়ান , তোমার গান তো চাঁদেও বাজে। কি এটা ? সে বলল, এটা গান নয় , এটা মিউজিক নয়। এটা হচ্ছে আজান।
এই ওয়াজের আরেকটু বিস্তারিত ফুটেজ পাওয়া যায় Islamic Network World নামক ইউটিউব চ্যনেলের এই ভিডিওতে।
এছাড়া ফেসবুকে অন্য কিছু পোস্ট এবং ভিডিওতে নিল আর্মস্টং এর ইসলাম গ্রহণের দাবিও করা হয়েছে। যেমন দেখুন এখানে , এখানে , এখানে , এখানে ।
অর্থাৎ, এসব পোস্টে মূলত ৩ টি দাবি তোলা হয়েছে। এগুলো হল-
১। নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করার প্রমাণ হিসেবে বিশাল বড় ফাটল দেখতে পেয়েছিলেন ।
২। তিনি চাঁদে আজান এর ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন।
৩। তিনি পৃথিবীতে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান
১৯৬৯ সালে এ্যাপোলো-১১ নভোযানের সাহায্যে আমেরিকার ৩ নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স চাঁদে অভিযান পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে নিল আর্মস্ট্রং ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই প্রথমবারের মত চাঁদে পদার্পণ করেন।
নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার পরপরই নিল আর্মস্ট্রংকে নিয়ে প্রচুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম , আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং নিল আর্মস্ট্রং ব্যক্তিগতভাবে এসব গুজব খণ্ডন করেছেন।
১৯৮৩ সালে US State Department উক্ত তিন মুসলিম দেশসহ অনেক মুসলিম দেশের অ্যাম্বেসি ও কনসুলেটগুলোতে একটি স্টেটমেন্ট পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন যে, নীল আর্মস্ট্রং মুসলিম হন নি।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর পাঠানো বিবৃতিটি দেখতে পাবেন এখানে কিংবা এখানে ।
কাছাকাছি সময়ে, (১৯৮৩ সালের ৫ই মে) দিল্লীর ইসলামিক সেন্টার এর সভাপতি জনাব ওয়াহুদুদ্দিন খানকে লেখা এক চিঠিতে নিল আর্মস্ট্রং জানান, চাঁদে আজানের ধ্বনি শোনা এবং ইসলাম গ্রহণ করার গল্পগুলো সত্য নয়।
২০০৫ সালে মালয়েশিয়া ভ্রমণকালে এক সাক্ষাৎকারে চাঁদে আজান শোনা’র দাবি অস্বীকার করেন। তার সেই সময়কার খবর দেখতে পাবেন মালয়েশিয়ার স্থানীয় পত্রিকা ‘ দি স্টার’ এ , এখানে ।
নাসা’র লুনার সায়েন্স ইন্সটিটিউট এর বিজ্ঞানী Brad Bailey এ এফ পি কে জানিয়েছেন, বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী অতীতের কোনো সময়ে চাঁদের দুই বা ততোধিক খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং পুনরায় তাদের একত্রিত হওয়ার কোনো আলামত পাওয়া যায় না।
তবে চাঁদের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ নদীর মত খাদ দেখা যায়। এদেরকে রাইল (Rille) বলে। এ সমস্ত রাইল কয়েক কিলোমিটার চওড়া এবং কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা হতে দেখা যায়। টেকটোনিক প্লেটের নানাবিধ কার্যক্রমের ফলে এসব রাইলের উৎপত্তি হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। এসব রাইল কোনোটাই চাঁদের সম্পূর্ণ পৃষ্ঠব্যাপী বিস্তৃত নয়, এবং তারা বেশি গভীর ও নয়।
যেকোনো পাথুরে গ্রহে বা উপগ্রহে এ ধরনের লম্বা টানা গর্ত খুব স্বাভাবিক । যেকোনো গ্রহ বা উপগ্রহের টেকটোনিক প্লেটগুলো সর্বদা পরিবর্তনশীল। ২ টা প্লেট যখন একে অপরকে ধাক্কা দেয়, তখন এদের মাঝে পাহাড়,পর্বত গড়ে ওঠে ( উদাহরন-হিমালয় পর্বতমালা )। কিন্তু ২ টা টেকটোনিক প্লেট যখন একে অপর থেকে দূরে সরে যায় , তখন এই ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়। (যেমন-অস্ট্রেলিয়ার গ্রান্ড ক্যানিয়ন) পৃথিবীতে যেহেতু বায়ুপ্রবাহ এবং পানি আছে, তাই এ ধরনের গর্ত তৈরি হলে আশেপাশ থেকে পানি,কিংবা বায়ুর সাহায্যে অন্য ধূলা,বালি,মাটি এসে শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলে। ফলে পৃথিবীতে এই ধরনের লম্বা খাঁদ একটু বিরল।
তবে চাঁদে যেহেতু পানি, বা বায়ু কিছুই নেই, তাই বছরের পর বছর এ সকল রাইল অবিকৃত অবস্থায় থেকে যায়।
চাঁদের এই ধরনের কিছু রাইল এর ছবিকেই ‘চাঁদ দ্বিখণ্ডন’ এর প্রমাণ হিসেবে দাবি করে অনেকে গুজব ছড়িয়েছে বিভিন্ন সময়ে । এ এফ পি ফ্যাক্টচেক এর এই ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদনে এই ধরনের দাবি নাকচ করা হয়েছে।
এছাড়া, শব্দের বৈশিষ্ট্য থেকে জানা যায় , শব্দ পরিবহন এর জন্য যেকোনো মাধ্যম (কঠিন/তরল/বায়বীয়) দরকার হয়। মাধ্যমের অণুগুলোকে ধাক্কা দেওয়ার মাধ্যমেই শব্দ এক স্থান হতে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হতে পারে। যে মাধ্যমের অণুগুলো যত ঘন, সেই মাধ্যমে শব্দ তত দ্রুত সঞ্চালিত হয়। এ কারণে কঠিন মাধ্যমে শব্দের বেগ সবচেয়ে বেশি এবং বায়বীয় মাধ্যমে শব্দের বেগ সবচেয়ে কম।
একই কারণে, যেখানে কোনো মাধ্যম নেই ( শূন্য মাধ্যম, কিংবা বায়ুশূন্য স্থান) সেখানে কোনো শব্দ সঞ্চালিত হতে পারবে না। ফলে কোনো শব্দ শোনা যাবে না ।
চাঁদে যেহেতু কোনো বায়ু নেই, তাই সেখানে আজান কিংবা কোনো ধরনের শব্দ শোনা সম্ভব নয়।
শূন্য মাধ্যমে শব্দ শোনা কিংবা না-শোনা নিয়ে ইউটিউবে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভিডিও রয়েছে। যেমন এখানে , এখানে ।
সারমর্ম
নিল আর্মস্ট্রং এর নাম ব্যবহার করে চাঁদ সম্পর্কিত যে দাবিগুলো করা হচ্ছে, এগুলোর কোনোটিই সত্য নয়। নিল আর্মস্ট্রং নিজে বিভিন্ন সময়ে এসব দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, এসব ঘটনা সম্ভব নয়। তাই ফ্যাক্টওয়াচ নিল আর্মস্ট্রং-সংক্রান্ত এসব ফেসবুক পোস্টকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?