গায়ে নীল বর্ণের জ্যাকেট এবং পায়ে একজোড়া স্নিকার পরে মেষ তাড়ানোর লাঠির উপর দুই হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ (Mahmoud Ahmadinejad)। এরকম একটি ছবিই সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। দাবি করা হচ্ছে, ইরানের এই সাবেক রাষ্ট্রপতি এখন মেষ চড়াচ্ছেন। ছবিতে তাঁর বেশভূষা সেটিই নির্দেশ করছে কিনা! তবে ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে দেখেছে, ছবিটি ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের ইরানের মাজান্দারান প্রদেশের একটি গ্রাম পরিদর্শন করতে যাওয়ার সময় তোলা হয়েছিল। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাছাড়া, বিবিসি ভেরিফাইয়ের একজন সাংবাদিকও মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মেষ চড়ানোর দাবিটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ১৯ মে ২০২৪ এ ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট কে হবেন – সেই তালিকায় আহমেদিনেজাদের নামও শোনা যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে “মিথ্যা” বলে সাব্যস্ত করছে।
অনুসন্ধান:
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মেষ পালনের দাবি সংবলিত ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে আমরা উক্ত ছবিটি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করি। আমাদের অনুসন্ধানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক তথ্য-যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলোর মাঝে ইরানের সংবাদমাধ্যম কুদস অনলাইনের একটি প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, মাহমুদ আহমেদিনেজাদ তাঁর ৬০ তম জন্মদিনে আবদুলরেজা শেখ উল-ইসলামি’র (Abdolreza Sheikhul-Islami) সাথে ইরানের মাজান্দারান প্রদেশের কাজুর জেলার কান্দলুস নামক একটি গ্রাম পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন এবং ছবিটি সেই সময় তোলা হয়েছিল। মূলত আহমেদিনেজাদ এবং আবদুলরেজা’র একত্রে তোলা পূর্ণাঙ্গ ছবিটিকে কেটে আহমেদিনেজাদের অংশটুকু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আবদুলরেজা শেখ উল-ইসলামি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক শ্রম মন্ত্রী ছিলেন৷
মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মেষ পালনের দাবি সংক্রান্ত কয়েকটি পোস্টের নমুনা দেখবেন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এবং এখানে।
ইরানের আরেকটি সংবাদমাধ্যম গিল খবরের একটি প্রতিবেদনে মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এবং আবদুলরেজা শেখ উল-ইসলামি’র দেশটির মাজান্দারান প্রদেশের একটি গ্রাম পরিদর্শনের বেশকিছু ছবি পাওয়া গেছে, যেখানে তাঁদের পরিহিত পোশাকের সাথে কুদস অনলাইন থেকে প্রাপ্ত আহমেদিনেজাদ এবং আবদুলরেজা’র একত্রে তোলা ছবিটিতে দৃশ্যমান পোশাক-পরিচ্ছদের মিল রয়েছে।
গ্রিসের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ‘ELLINIKA HOAXES’ গত ২৭ মে ১০২৪ এ এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রতিবেদনটিতে মাহমুদ আহমেদিনেজাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর মেষ চড়ানোর দাবিটিকে নাকচ করে দেয়ার পাশাপাশি আরও জানানো হয়েছে যে, ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর আহমেদিনেজাদকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনি (Ali Khamenei) এক্সপেডিয়েন্সি ডিজসার্নমেন্ট কাউন্সিলে নিয়োগ দেন, যা দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে। মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ২০১৭ এবং ২০২১ সালে ইরানের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য নিবন্ধন করলেও দেশটির গার্ড কাউন্সিল তাঁর প্রার্থীতা বাতিল করে দেয়। সম্প্রতি ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির আকস্মিক মৃত্যুর পর দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন – সেই প্রতিযোগিতায় আহমেদিনেজাদের নাম উঠে এসেছে।
একই বিষয়ে ফ্রান্স-ভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ‘The Observers’ এবং তুরস্কের মিডিয়া ওয়াচডগ ‘Teyit’ এর দুটো প্রতিবেদন পড়ুন এখানে এবং এখানে।
আমাদের অনুসন্ধানে মাহমুদ আহমেদিনেজাদের নামে একটি এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেল খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে গত ২৮ আগস্ট ২০১৮ এ শেয়ারকৃত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনি একটি অফিসকক্ষে বসে কাজ করছেন৷ এ থেকে বুঝা গেলো যে, ইরানের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট সবকিছু বাদ দিয়ে মেষ চড়াচ্ছেন না৷
তাছাড়া, Shayan Sardarizadeh নামক বিবিসি ভেরিফাইয়ের একজন সাংবাদিক গত ২২ মে ২০২৪ এ তাঁর এক্স হ্যান্ডেল থেকে কুদস অনলাইনের প্রতিবেদনটির একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করে জানান যে, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ তাঁর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে “শান্তিপূর্ণভাবে মেষ পালন” করছেন না, বরং তিনি বর্তমানে তেহরানে আছেন এবং কাজ করছেন।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমে মাহমুদ আহমেদিনেজাদের মেষ চড়ানোর দাবি সংবলিত যে ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো তাঁর একটি গ্রাম পরিদর্শনকালে তোলা এবং বর্তমানে তিনি বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছেন এবং রাজনীতিতে ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছেন।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ছবিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট দাবিকে মিথ্যা বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।