যা দাবি করা হচ্ছে : ফরিদপুরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এক ভারতীয় নাগরিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
যা পাওয়া যাচ্ছে : ১৬ই সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ফরিদপুর ভাঙা বাজার থেকে আটককৃত একজন ব্যক্তিকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ১৭ই সেপ্টেম্বর ফরিদপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে পূর্বের ভুল সংশোধন করে তাকে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এসব পোস্টে বলা হয়েছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত সঞ্জিত বিশ্বাস নামে এক ভারতীয় নাগরিককে আটক করা হয়েছে।
অনুসন্ধান
১৫ই সেপ্টেম্বর কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌরসভার হরি মন্দিরের আটটি প্রতিমার বিভিন্ন অংশে ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। শনিবার (১৪ই সেপ্টেম্বর) দিবাগত গভীর রাতে ভাঙ্গা সদর বাজারের গুড়পট্টি এলাকার হরি মন্দিরের এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে ভাঙ্গার হরি মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক অরুণচন্দ্র সাহা বলেন, “এই মন্দিরে মোট ১৪ টি প্রতিমা ছিল, এর মধ্যে আটটি প্রতিমা দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন অংশে ভেঙে ফেলে। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট পুলিশকে জানালে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।”
এ সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন দেখতে পাবেন এখানে,এখানে।
পরবর্তীতে, ১৬ই সেপ্টেম্বর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, সোমবার (১৬ ই সেপ্টেম্বর) বিকেলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আব্দুল জলিল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় প্রতিমা ভাঙচুরের সন্দেহে সঞ্জিত বিশ্বাস (৪৫) নামের এক ভারতীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দেশ টিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফরিদপুরে প্রতিমা ভাঙচুর, ভারতীয় নাগরিক গ্রেপ্তার শীর্ষক খবরে বলা হয়েছে, বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত শনিবার ( ১৪ ই সেপ্টেম্বর) রাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজারস্থ হরি মন্দির ও কালি মন্দিরে নির্মিতব্য প্রতিমা কে বা কারা ভাঙচুর করেছে এমন খবরের প্রেক্ষাপটে রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার। পরিদর্শনকালে তিনি হরি মন্দিরের কয়েকটি প্রতিমার বিভিন্ন অংশ ভাঙার চিত্র দেখতে পান। এ সময় তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীর নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার বিষয়ে তদন্তকালে কালি মন্দিরের সামনে পরিত্যক্ত খাটের উপর শয়নরত অবস্থায় একজন ও খাটের পাশে মাটিতে আরেকজন ব্যক্তিকে দেখা যায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে একজনকে (বৃদ্ধ ব্যক্তি) স্থানীয়রা পরিচিত বলে শনাক্ত করেন। আরেক ব্যক্তির নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নাম-পরিচয় না জানালে তার উপর সন্দেহ হওয়ায় তাকে থানায় এনে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদকালে একবার বাংলা এবং একবার হিন্দি ভাষায় কথা বলেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, তার নাম সঞ্জিত বিশ্বাস (৪৫), পিতা- নিশি কান্ত বিশ্বাস, সাং- নদীয়া এবং তিনি ভারতীয় নাগরিক।
অনুরূপ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় কালের কণ্ঠ,কালবেলা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ।
তবে ফরিদপুর জেলা পুলিশ এর প্রেস বিজ্ঞপ্তির বাইরে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম তাদের নিজস্ব সংবাদদাতার মাধ্যমে কিছু অতিরিক্ত তথ্য যুক্ত করেছে। যেমন দ্য ডেইলি স্টার এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে, ওই ব্যক্তি মানসিক ভারসাম্যহীন। গত দেড় মাস ধরে তাকে ভাঙ্গা বাজার, ভাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখা গেছে। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনেও একই তথ্য রয়েছে।
এর পরদিন, ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই ঘটনার ফলো-আপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ফরিদপুর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পাঠানো আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সঞ্জিত বিশ্বাস (৪৫) ভারতীয় নন, বাংলাদেশের নাগরিক।
বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডট কম এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) পুলিশ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গতকাল সোমবার বিভিন্ন মিডিয়ায় এই খবর প্রকাশিত হলে সঞ্জিত বিশ্বাসের ছবি দেখে তার বাবা নিশিকান্ত বিশ্বাস (৭২) জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান যে, আটক ব্যক্তি তার ছেলে। তিনি (সঞ্জিত) মানসিকভাবে অসুস্থ। ২৫ বছর বয়সে কাজের উদ্দেশে ভারতে গিয়ে অনেকদিন ছিলেন। পরবর্তীকালে দেশে ফিরে আসেন। এর মধ্যে প্রায় ৪ বছর আগে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন সঞ্জিত, আর বাড়িতে ফিরে আসেননি এবং পরিবারের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই।
বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর ডট কম এর খবরে বলা হয়েছে, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় হরি মন্দির ও কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তি ভারতীয় নাগরিক নয় বলে দাবি করছে পুলিশ।
তাকে গ্রেপ্তারের একদিন পর মঙ্গলবার ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন বলেন, “ভাঙ্গার হরি মন্দির ও কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় সোমবার আমাদের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হলে সঞ্জিত বিশ্বাসের বাবা নিশিকান্ত বিশ্বাস (৭২) ফরিদপুর জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তিনি জানান যে, আটক ব্যক্তি তার ছেলে। তার নাম সঞ্জিত বিশ্বাস, সেটাও তিনিই জানিয়েছিলেন।
“নিশিকান্ত আরও বলেন যে, সঞ্জিত মানসিকভাবে অসুস্থ। সে প্রায় ২৪-২৫ বছর বয়সে কাজের উদ্দেশ্যে ভারতে গিয়ে দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পরে দেশে ফেরেন। এরপর প্রায় চার বছর আগে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়, আর বাড়িতে ফিরে আসেনি এবং পরিবারের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নাই।”
পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, “মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ব্যক্তি ভারতে নাগরিক নন, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বা মানসিক বিকারগ্রস্ত।”
জার্মানিভিত্তিক ডয়েচে ভেলেতে প্রকাশিত মূর্তি ভাংচুরের অভিযোগ: যেভাবে বাংলাদেশি হয়ে যান ‘ভারতীয়’শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙ্গা উপজেলায় এক মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে পুলিশ৷ প্রথমে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ জানায় তিনি ভারতীয়৷ সংবাদমাধ্যমেও চলে আসে সেই খবর৷ পরে জানা যায়, গ্রেপ্তার করা ব্যক্তি ভারতীয় নন, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক৷
পুলিশ যাকে ‘ভারতীয়’ ধরে নিয়ে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিল তার নাম সঞ্জিত বিশ্বাস (৪৫), বাবার নাম নিশিকান্ত বিশ্বাস, বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলায়৷ ডয়চে ভেলেকে নিশিকান্ত বিশ্বাস জানান, তার ছেলে মানসিক ভারসাম্য হারানোর ফলে ২০১৯ সাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন৷ সংবাদপত্রে ছবি দেখে সঞ্জিতের সন্ধান পেয়েছেন তারা৷
অথচ সঞ্জিতের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে, এমনকি প্রতিমা ভাংচুরের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো অভিযোগ বা তথ্য না পেয়েই পুলিশের পক্ষ থেকে সোমবার গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়৷ সেই তথ্য যাচাই-বাছাই না করে খবরও প্রকাশ করা হয়৷ ……।কিন্তু ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য। মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে কিনা ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আসামি ধরার কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছে পুলিশ, পাসপোর্ট বা অন্য কোনো পরিচয়পত্র না দেখা সত্ত্বেও তাকে ভারতীয় নাগরিক সাব্যস্ত করে দ্রুত খবর প্রচারে উদ্যোগ নিয়েছে, সংবাদমাধ্যমের একটা অংশও কোনো যাচাই-বাছাইয়ে না গিয়ে হুবহু প্রচার করেছে সেই ‘কাল্পনিক’ তথ্য৷ অথচ খুব সহজেই সঞ্জিতের জাতীয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যেতো৷ আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে পরীক্ষা করলেই পুলিশ জানতে পারতো সঞ্জিত বাংলাদেশের নাগরিক৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেই অবশ্য পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে৷ পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে সঞ্জিতের পরিবারের সঙ্গে৷
ফরিদপুর জেলা পুলিশের ওয়েবসাইটে সাম্প্রতিক এই ঘটনা সম্পর্কে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি বা খবর খুজে পাওয়া যায়নি। ফরিদপুর জেলা পুলিশের অফিসিয়াল পেইজ জেলা পুলিশ, ফরিদপুর থেকেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে কোনো পোস্ট বা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখা যাচ্ছেনা। তবে যেসকল সংবাদমাধ্যমে ফরিদপুরের মন্দিরে প্রতিমা ভাঙা ও সঞ্জিত বিশ্বাসের পরিচয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেসকল প্রতিবেদন এই পেজ থেকে শেয়ার করা হয়েছে। এই পেজ থেকে সর্বশেষ শেয়ার করা প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল – প্রতিমা ভাঙচুর করা সেই ব্যক্তি ভারতীয় নয়, গোপালগঞ্জের নাগরিক।
সিদ্ধান্ত
জেলা পুলিশ, ফরিদপুর এর পক্ষ থেকে পাঠানো একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার ভাঙা বাজারে মন্দিরের প্রতিমা ভাঙার সাথে জড়িত সন্দেহে জনৈক ‘ভারতীয় নাগরিক’ গ্রেফতারের খবর প্রচার করেছিল। তবে পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলা পুলিশ আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আটককৃত উক্ত ব্যক্তি ভারতীয় নাগরিক নন, বরং বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের বাসিন্দা। তবে এই নতুন সংবাদ প্রচারের পরেও অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী তাদের পুরনো পোস্টগুলো সংশোধন করে নেয়নি, যার ফলে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।
সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভারতীয় নাগরিক গ্রেফতারের দাবিযুক্ত এই সকল পোস্টকে ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
No Factcheck schema data available.
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের
নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।
কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh