যাদাবিকরাহচ্ছে: বাংলাদেশের সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়া গিয়েছে- এমন দাবি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দুই ধরণের পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমত, কয়েকটি ভাইরাল ভিডিওতে সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার দাবি করা হয়েছে । দ্বিতীয়ত, একটি লাশের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে যে, এটি সংসদ ভবন থেকে উদ্ধার করা লাশ।
যাপাওয়াযাচ্ছে: সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়ার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি এবং যে লাশের ছবি সংসদ ভবনে পাওয়া গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে সেটা ঝিনাইদহের এক আওয়ামী লীগ নেতার লাশের ছবি।
(সতর্কতা : এই প্রতিবেদনে কিছু সংবেদনশীল ছবি ব্যবহৃত হয়েছে। পাঠকের সতর্কতা কাম্য)
গত ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে গণভবন এবং জাতীয় সংসদ ভবনে বিপুলসংখ্যক আগ্রহী দর্শক ঢুকে পড়েন। সেদিন রাতে সংসদ ভবনে গণকবরের গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মূলত Samira Islam Afroz নামক একটি ফেসবুক আইডি থেকে দুইটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যে ভিডিওগুলো পরবর্তীতে অন্যরাও পুনরায় আপলোড করে ছড়িয়ে দেন ( ভিডিও দুটির একটির ক্যাপশন ছিল ‘সংসদ ভবনে লাশের গন্ধে ডুকা যাচ্ছে না’ অপর ভিডিওতে লেখা ছিলো, “যেসব ছাত্রছাত্রীদের গণকবর দেওয়া হয়েছে, তাদের বইখাতা পাওয়া গেছে সংসদ ভবনে।) ” তবে এসব ভিডিওতে ভাষ্যকারকে কেবলমাত্র সংসদ ভবন এলাকায় ইতস্তত হাটতে দেখা যায়, এবং কিছু খাতাপত্র দেখা যায়। কোনো কোন লাশ বা গণকবরের দেখা পাওয়া যায়নি। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আইডি থেকে ভিডিও দুটো সরিয়ে ফেলা হয়।
পরবর্তীতে উক্ত আইডিটি থেকে লাইভে এসে ভিডিওকারী জানান, তিনি বিজয় মিছিলে অংশ নিতে সংসদ ভবন এলাকায় যান। সংসদ ভবনের পেছনের গেট দিয়ে ঢোকার সময় শুনতে পান সবাই বলছে ভেতরে গণকবর ও শিক্ষার্থীদের বইখাতা পাওয়া গেছে। তিনি আরও জানান, সন্ধ্যার পর অনেকে মাটি খুঁড়ছিল। তবে তিনি কোনো লাশ দেখতে পাননি। ভিডিওতে তিনি আরও বলেন, “বাসায় আসার পর বুঝতে পারলাম আসলে নিউজটি গুজব। তারপর আমি পোস্টটা সাথে সাথে ডিলিট করে দেই।”
সংসদে গণকবর আছে কিনা তা যাচাই করতে ডিসমিসল্যাবের একজন প্রতিনিধি সংসদ ভবন এলাকা পরিদর্শনে যান। তবে তিনি সেখানে কোনো গণকবরের সন্ধান পাননি। ডিসমিসল্যাব জানাচ্ছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও স্বতন্ত্রভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গণকবরের বিষয়টিকে গুজব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
সংসদ ভবনে গণকবর অনুসন্ধান শেষে কালবেলার সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ জার্নালিজম স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সভাপতি আকরাম হোসেইন তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন “সংসদ ভবনে গণকববের সন্ধানে যা পাওয়া গেল। যমুনা টিভি, কালবেলাসহ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক কিছুক্ষণ আগে সংসদ ভবনের পেছনে গণকবরের সন্ধানে গিয়ে কিছু বই খাতা পেয়েছি। এবং গন্ধ পেয়েছি।
বই খাতা- বই খাতা গুলোতে ২/৩ জনের নাম পেয়েছি। তারমধ্যে ১ জনের মোবাইল নাম্বার পেয়েছি যার নাম নাইমুর রহমান। নাম্বারে কল দিয়ে জানতে পারি তিনি সংসদ ভবনের কর্মচারী তার ছেলের নাম নাইমুর রহমান। তাদের বাসায় ভাংচুর করা হয়েছে এবং ছেলের বই খাতা সবকিছু নিয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে বই খাতা গুলো কেউ ফেলে রেখে গেছে।
গন্ধ- আমরা একটা গন্ধ পেয়েছি। তবে আমরা কোনো কবরের সন্ধান পাই নাই। আর যে গন্ধ টা পাওয়া যাচ্ছে সেটা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকেও আসছে না। ধারণা করা হচ্ছে কোনো মৃত প্রাণীর গন্ধ হতে পারে।
এছাড়া, ৬ আগস্ট Shadhin Studio নামের একটি ফেসবুক পেজে প্রচারিত ভিডিওতে সংসদ ভবন এলাকায় মাটি খুঁড়ে কথিত গণকবর খোঁজার দৃশ্য দেখা যায়। তবে এই ভিডিওতেও কোনো গণকবর থাকার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অতএব সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে সংসদ ভবনে কোন গণকবর নেই।
দ্বিতীয়ত, কিছু লাশের ছবি পোস্ট করে দাবি করা হচ্ছে সেগুলো সংসদ ভবন থেকে উদ্ধার করা লাশ। এমন কয়েকটি পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে। রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ,এখানে একাধিক লাশ নেই, বরং একটি লাশেরই একাধিক ছবি রয়েছে। আর নিহত এই ব্যক্তিটি হলেন ঝিনাইদহের জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা হিরন।
৫ আগস্ট Harun Sp নামক একটি ফেসবুক আইডি থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা ছিলো “ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওপর হাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিরন কে জনতা জুতা পিটিয়ে মেরে ফেলল 😁 জয় বাংলা হয়ে গেছে 🫣”। ভিডিওতে দেখা যায় উন্মত্ত জনতা একটি লাশ বেঁধে রেখে পিটাচ্ছে।
এই ভিডিওতে থাকা এই হিরন চেয়ারম্যানের লাশের সাথে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবির লাশের মিল আছে।
৫ই আগস্ট ‘এই মুহুর্তে ঝিনাইদহের অবস্থা …’ ক্যাপশনে হিরন চেয়ারম্যানের লাশকে মারার ভিডিও প্রকাশ করেন Shoriful Islam Lemon নামক এক ফেসবুক ব্যবহারকারী।
৫ই আগস্ট, ২০২৪ তারিখে “গুলি করেও বাঁচতে পারলেন না আলোচিত হিরণ চেয়ারম্যান” শিরোনামে ঢাকা পোস্ট একটি খবর প্রকাশ করে। সেখান থেকে জানা যায় ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা ৯নং পোড়াহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরন ও তার গাড়িচালক আক্তার হোসেনকে কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর হিরনের লাশ শহরের কেন্দ্রস্থল পায়রা চত্বরে টাঙিয়ে রাখা হয়।
অর্থ্যৎ ঢাকা পোস্টের খবর থেকে হিরন চেয়ারম্যানের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এছাড়া, ফেসবুকে অনেকে কোনো ছবি বা ভিডিও প্রকাশ ছাড়াই দাবি করছেন যে সংসদ ভবনে গণকবর পাওয়া গিয়েছে , যে দাবির সপক্ষে মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সঙ্গত কারণে সংসদ ভবনে গণকবর এবং লাশ উদ্ধারের দাবিকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।