সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রাসেল’স ভাইপার সাপ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় অনেকে এটিকে অন্যান্য নির্বিষ সাপের সাথে গুলিয়ে ফেলছেন। এবার “সিলেটের জকিগঞ্জে রাসেল’স ভাইপার পাওয়া গেছে” বলে একটি পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, উক্ত পোস্টটিতে যে সাপটি দেখা যাচ্ছে সেটি নির্বিষ ঘরগিন্নি (Common Wolf Snake) সাপ। বিষধর রাসেল’স ভাইপার এবং নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা দেখে ফ্যাক্টওয়াচ টিম নিশ্চিত হয়েছে আলোচিত পোস্টে দৃশ্যমান সাপটি রাসেল’স ভাইপার নয়। সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টটিকে “বিভ্রান্তিকর” বলে সাব্যস্ত করছে।
অনুসন্ধান:
সিলেটের জকিগঞ্জে রাসেল’স ভাইপার সাপ পাওয়া গেছে দাবি করে সামাজিক মাধ্যমে যে সাপের ছবিটি ছড়িয়ে পড়েছে সেটি নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপ। এই সাপের কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: এদের গায়ের রঙ ধূসর বাদামী, খয়েরী, এবং কালো বর্ণের হয়, এদের পিঠে কিছুটা বিরতি দিয়ে দিয়ে সাদা কিংবা হলদে রঙের চুড়ির মতো বলয় থাকে। এই বলয়ের কারণে অনেকে এটিকে ক্রেইট প্রজাতির কালাচ সাপ (Common Krait) বলে ভুল করেন। তবে, কালাচের শরীরের চুড়ির মতো বলয়গুলোর মাঝে ফাঁক কম থাকে এবং বলয়গুলো ঘরগিন্নির তুলনায় সরু হয়। ঘরগিন্নি সাপের মাথা তার ঘাড়ের তুলনায় চওড়া হয় এবং এর ঘাড়ের কাছেও চুড়ির মতো বলয় থাকে, যা দেখে এটিকে কালাচ সাপ থেকে আলাদা করা যায়। এদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ছোট সরিসৃপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, প্রভৃতি রয়েছে এবং এরা রাতে শিকার করতে বের হয়। নির্বিষ হলেও ঘরগিন্নি সাপ কামড়ালে সেই জায়গায় প্রচুর ব্যথা হয়। মূলত মানুষের আবাসস্থল কিংবা এর আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে ঘরগিন্নি।
Common Wolf Snake. Credit: alamyCredit: Indian Snakes
অন্যদিকে, রাসেল’স ভাইপারের কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: এদের মাথা ত্রিকোণাকৃতি বা অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালা ‘V’ এর মতো দেখতে, এদের মাথা ঘাড় থেকেও চওড়া হয়, এদের নাসারন্ধ্র ছোট এবং চোখের মণি খাঁড়া হয়। রাসেল’স ভাইপার সাপকে অন্যান্য সাপ থেকে আলাদা করে চেনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ফ্যাকাশে কমলা বাদামী রঙের পিঠের উপর লালচে বাদামী রঙের ডিম্বাকৃতি বা চাকতির মতো দেখতে কালো বর্ণের সীমানাযুক্ত বড় বড় বৃত্ত, যা মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তিনটি সারিতে শেকলের মতো চলে গেছে। রাসেল’স ভাইপার সাপের শরীরে এই চাকতির মতো কালো রঙের সীমানাযুক্ত বৃ্ত্তগুলো কিছুটা চাঁদের মতো দেখতে হওয়ায় বাংলায় এই সাপকে বলা হয় চন্দ্রবোড়া। রাসেল’স ভাইপার সাপ তার এই অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ত্বকের গঠনের কারণে এবং এর চামড়া দিয়ে শৌখিন জিনিস তৈরি হয় বলে এদের শিকার করা হয়। বিপদের সম্মুখীন হলে রাসেল’স ভাইপার কুন্ডলী পাকিয়ে ‘ফোঁস ফোঁস’ শব্দ করে শত্রুকে লক্ষ্য করে সতর্কবার্তা পাঠাতে থাকে এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাসের ফলে এর শরীর স্বাভাবিক আকারের চেয়ে বেশি ফেঁপে উঠে।
Russell’s Viper. Credit: Wikipedia
অতএব, উপরে দুটো সাপের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টে যে সাপটিকে রাসেল’স ভাইপার বলা হচ্ছে সেটি আসলে নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপ।
তাছাড়া, ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে পূ্র্বে এবং বর্তমানে রাসেল’স ভাইপার সাপের বিস্তার নিয়ে একটি ম্যাপ তৈরি করেছে। উক্ত ম্যাপে দেখা গেছে, সিলেট জেলায় পূ্র্ব কিংবা বর্তমান সময়ে রাসেল’স ভাইপার সাপের বিস্তারের রেকর্ড নেই।
Credit: Deep Ecology and Snake Conservation Foundation
এর আগেও অন্য দুটো মৃদু বিষধর এবং নির্বিষ সাপকে রাসেল’স ভাইপার সাপ বলে প্রচার করেছিল বেশকিছু সংবাদমাধ্যম। সেগুলো নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিবেদন পড়ুন এখানে এবং এখানে।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত পোস্টটিকে বিভ্রান্তিকর বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।