যা দাবি করা হয়েছে: পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন লাগিয়েছে পুলিশ সদস্য। এমন দাবির পক্ষে চ্যানেল ২৪ থেকে প্রকাশিত একটি ভিডিও চিত্র থেকে মাত্র ১৭ সেকেন্ডের খণ্ডিত ভিডিও ফুটেজ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে।
যা পাওয়া যাচ্ছে: দাবিটি “মিথ্যা”। পেট্রোল নয় জ্বলন্ত বাসের আগুন নেভাতে পানি দিয়েছিলেন ঐ পুলিশ সদস্য। মূলত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে আগুন লাগিয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে আশে-পাশে থাকা জনসাধারণ ও পুলিশ সদস্যরা আগুন লেভানোর চেষ্টা করেন এবং আগুন নেভাতে সক্ষম হন। আগুন নেভানোর কাজে শুরুতে তাঁরা বোতলের পানি ব্যবহার করেন। চ্যানেল ২৪ থেকে প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে মূল ঘটনাটি জানা গেছে।
১২ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে চ্যানেল ২৪ থেকে “রাজধানীতে আবারও বাসে আগুন” শিরোনামে ৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি মূলত লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়। ৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ভিডিওটির ১ মিনিট ২০ সেকেন্ড অংশে একজন পুলিশ সদস্যকে বাসের আগুনের ভিতরে বোতল থেকে তরল জাতীয় কিছু ঢালতে দেখা যাচ্ছে। পরবর্তীতে পুরো ভিডিওটি থেকে ১৭ সেকেন্ড অংশ নেয়া হয়েছে, অর্থাৎ যেখানে পুলিশ সদস্যকে বাসের আগুনে বোতল থেকে কোনো তরল পদার্থ ঢালতে দেখা যাচ্ছে। এই অংশটুকুই ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করা হয়েছে “বোতলে করে বাসে পেট্রোল ঢেলে পুলিশ আগুন লাগাচ্ছে”। খুব দ্রুতই উক্ত দাবিসহ ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:
ভাইরাল ভিডিওটির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিভিন্ন কী-ওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করা হয়। সেখান থেকে পাওয়া যায় যে, “ঢিলেঢালা অবরোধে পুলিশের সামনেই বাসে আগুন” শিরোনামে চ্যানেল ২৪ থেকে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। ২ মিনিট ২৯ সেকেন্ডের প্রতিবেদনটি পাওয়া যাবে এখানে। বাসে আগুন লাগার এই ঘটনাটি নিয়ে চ্যানেল ২৪ এর অন্য প্রতিবেদনগুলোও পর্যবেক্ষণ করা হয়।
৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের ভিডিও প্রতিবেদনটির সারমর্ম:
মিরপুর-১০ গোলচত্বর থেকে সরাসরি যুক্ত হন চ্যানেল ২৪ এর প্রতিনিধি সুলতান মাহমুদ আরিফ। সংবাদ উপস্থাপকের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয় অবরোধের পক্ষে-বিপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি চোখে পড়েছে কি না, যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে কি না। প্রতিবেদক ১৩ সেকেন্ড অংশ থেকে চতুর্থ দফা অবরোধ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তখনও পর্যন্ত প্রতিবেদক জানতেন না মিরপুর-১০ গোলচত্বরে প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে আগুন লেগেছে। ভিডিওর ২৩ সেকেন্ড অংশে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলতে শুরু করেন:
“একটু আগে একটি বাসে আগুন দিয়েছে। এই আমি যখন আপনার সাথে কথা বলছি ঠিক সেই মুহুর্তেই। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে প্রজাপতি পরিবহন, অর্থাৎ মিরপুর ১০ গোলচত্বরে দূর্বৃত্তরা প্রজাপতি পরিবহনে আগুন দিয়ে পালিয়ে গেছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে বাসটিতে দাউদাউ করে ভিতরে আগুন জ্বলছে। এবং ভিতরে কয়েকজন যাত্রী ছিলেন, যাত্রীরা নেমে যায়। ঠিক গাড়িটির পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন এবং আমরাও ঠিক যখন আপনাকে এখানকার পরিস্থিতি দেখাচ্ছিলাম ঠিক তখনই এখানে আগুনটি দেওয়া এবং সাথে সাথে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহজনক একজনকে আটক করে…। প্রজাপতি পরিবহনে কিন্তু আগুন জ্বলছে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থাৎপুলিশ সদস্য যারা আছেন তারা কিন্তু বোতলে করে পানি দিয়ে আগুন নির্বাপণের চেষ্টা করছেন।যেহেতু এটি কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা, এখনও এক দেড় মিনিটও হয়নি তাই এখানে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস আসেনি।…. কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আগুনটি লাগে এবং মূলত এরপরই পুলিশ সদস্যরা এসে আগুনটি নির্বাপণের চেষ্টা করেন।”
প্রতিবেদনটি দেখে ফ্যাক্টওয়াচের বিশ্লেষণ:
চ্যানেল ২৪ এর আপলোড করা ভিডিওটির ২৩ সেকেন্ড পরের অংশ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বাসের পিছনের দিকের সিটে আগুন লাগে। বাসটির একটু দূরে পুলিশের উপস্থিতি ছিল। আগুন লাগার সাথে-সাথে কয়েকজন পুলিশ ঐ বাসের দিকে ছুটে যান। উক্ত সময়ে বাসের যাত্রীদের দ্রুত বাস থেকে নামতে দেখা যায় এবং ভিতর থেকে কোনো একজনকে পানির বোতল নিয়ে আগুন লেগে যাওয়া পিছনের সিটের কাছে দৌড়াতে দেখা যায় এবং পানি ঢেলে আগুন নেভাতে চেষ্টা করতেও দেখা যায়। এরপরের অংশে দেখা যায়, সাদা পোশাকের একজন ব্যক্তি দ্রুত দৌড়ে এসে জানালা দিয়ে বোতলের পানি দিয়ে আগুন নেভাতে চেষ্টা করছেন। এর একটু পরের অংশে দেখা যায়, ইউনিফর্ম-পরা একজন পুলিশ সদস্য বোতল থেকে বাসের ভিতরে তরল জাতীয় কিছু ঢালছেন। বোতলে থাকা তরল পদার্থ যে পানিই — তার পক্ষে প্রমাণ হল, এই পুলিশ সদস্যের আগে আরও দুজন বোতল থেকে পানি ঢেলে আগুন নেভাতে চেষ্টা করেছেন। তাঁদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যটিও দৌড়ে এসে বাসের আগুন নেভাতে চেষ্টা করেছেন। চ্যানেল ২৪ এর লাইভ ভিডিওটিতে দেখা যায়, বাসটি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশেই ছিলো ফুলের দোকান। দোকানের কর্মচারীরা বালতি থেকে ফুল ফেলে দিয়ে বালতিতে থাকা পানি আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, সেদিন পুলিশ, সাধারণ জনতা এবং পাশে থাকা দোকানের কর্মচারীরা সবাই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন।
চ্যানেল ২৪ এর প্রতিনিধি সুলতান মাহমুদ আরিফ ৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের প্রতিবেদনে বারবার এই কথাটি উল্লেখ করেছিলেন যে পাশে-থাকা পুলিশের সময়োচিত উদ্যোগ ও পানি ব্যবহারের ফলে বাসের আগুন দ্রুতই নেভানো সম্ভব হয়েছে। ভিডিও প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে। প্রসঙ্গত, মূল ভিডিও থেকে যখন ১৭ সেকেন্ড অংশ ফেসবুকে খুব ভাইরাল হয়, এবং আগুন লাগিয়েছে পুলিশ এমন দাবি করা হয় তখন চ্যানেল ২৪ এর পক্ষ থেকে “চ্যানেল 24-এর ভিডিও এডিট করে অপপ্রচার” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
উল্লেখ্য, প্রজাপতি পরিবহনে আগুন লাগার ঘটনাটি নিয়ে মোহনা টিভিরও একটি লাইভ খুঁজে পাওয়া যায়৷ ঐ লাইভ ভিডিও থেকেও বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে যে, উপস্থিত লোকজন এবং পুলিশ সদস্যরা আগুন নেভাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, লাগাতে নয়।
তাই তথ্যপ্রমাণের আলোকে ভাইরাল দাবিগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ “মিথ্যা” সাব্যস্ত করেছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।