সময় যত এগুচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ অন্যান্য প্রযুক্তি তত হালনাগাদ হচ্ছে। কিছুদিন আগেও এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও সহজেই শনাক্ত করা যেত, ধরা পড়তো খালি চোখেই। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এসব ভিডিও এখন অনেক বেশি বাস্তব হয়ে উঠছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ভিডিও ছড়াচ্ছে কোনো ধরনের ডিসক্লেইমার ছাড়াই, কখনো কখনো ফেসবুকের এআই নীতিমালা না মেনেই। ফলে সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা এসব ভিডিওকে সত্য ভেবে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কখনো এসব ভিডিও তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু ডিসক্লেইমার না থাকা ও ফেসবুকের এআই নীতিমালা না মানায় এসব ভিডিও বা কনটেন্ট পড়ছে ফ্যাক্টচেকের আওতায়।
যেমন, সম্প্রতি ফেসবুকে ফ্রান্স প্রবাসী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে তাকে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় ফ্যাক্টচেকারদের সমালোচনা করতে শোনা যাচ্ছে। তিনি বলছেন, ভারতীয় ফ্যাক্টচেকাররা ফ্যাক্টচেকিংয়ের নামে বাংলাদেশে যারাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলছেন, আওয়াজ তুলছেন তাদেরকে সেন্সরশিপের আওতায় নিয়ে আসছেন।
তিনি আরও বলছেন, ভারতীয় পক্ষপাতদুষ্ট ফ্যাক্টচেকাররা বাংলাদেশিদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি কাল্পনিক কনটেন্টকেও ‘বিকৃত’, ‘মিথ্যা’ হিসেবে শনাক্ত করছে। ভিডিওটিতে ডিসক্লেইমারও দেওয়া ছিল। আর এভাবেই ফ্যাক্টচেকাররা “গোদি” মিডিয়ার সমর্থনে কাজ করছে।
এ সময় পর্দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে করা একটি ফেসবুক পোস্ট প্রদর্শন করা হয়। পোস্টটি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বেশ কিছু ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে এবং এতে প্রদর্শিত ভিডিওটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো বিকৃত এবং মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।
ভিডিওটি গত ২১ ফেব্রুয়ারি অল নিউজ (All News) ও আরটিনিউজ২৪ (RT News24) নামের দুটি ফেসবুক পেজ থেকে সম্মিলিতভাবে পোস্ট করা হয়। এটি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (১১ মার্চ) অল নিউজ (All News) পেজটি থেকে ৪৬ হাজার বার দেখা হয়েছে, রিয়েকশন পড়েছে প্রায় ৪ হাজার। পোস্টটির কমেন্টবক্সে মন্তব্য পড়েছে শতাধিক। এসব মন্তব্য বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, ফেসবুক ব্যবহারকারীরা পিনাকীর এই ভিডিওটিকে বাস্তব বলেই ধরে নিয়েছেন।
পিনাকী কি আসলেই এই সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন?
ভিডিওটি যাচাইয়ে দেখা যায় এটি ফ্রান্সের সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স২৪-এ দেওয়া পিনাকী ভট্টাচার্যের একটি সাক্ষাতকার। তিনি গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমটিকে এই সাক্ষাতকারটি দেন। সাক্ষাতকারটিতে পিনাকী জুলাই অভ্যুত্থানে তার ভূমিকা, জুলাই অভ্যুত্থান কেন হলো, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন, নির্বাচন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন। ভিডিওটিতে তিনি ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডসহ মাধ্যমটির বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বললেও কোথাও তিনি ভারতীয় ফ্যাক্টচেকার বা ফ্যাক্টচেকার কর্তৃক কোনো ভিডিও রেট করা নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
তাহলে ভিডিওটির সত্যতা কি
অল নিউজ পোস্টটির ক্যাপশনে লিখেছে, ভারতীয় ফ্যাক্টচেকাররা যেভাবে শেখ হাসিনার বিরোধীদের টার্গেট করছে। এই পোস্টে সংযুক্ত ভিডিওর সঙ্গে ফ্রান্স২৪-এ পিনাকীর দেওয়া সাক্ষাৎকারটির মিল অর্থাৎ ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড, উপস্থাপক, পিনাকীর পোশাক ইত্যাদির মিল রয়েছে। কিন্তু এখানে পিনাকী কথা বলছেন ভারতীয় ফ্যাক্টচেকারদের ভূমিকা নিয়ে। এ থেকে স্পষ্ট, ফ্রান্স২৪-এ দেওয়া পিনাকী ভট্টাচার্যের সাক্ষাতকারটিতে প্রযুক্তির সহায়তায় আলাদাভাবে যুক্ত করা হয়েছে। আর কাজটি করা হয়েছে এআই প্রযুক্তির সাহায্যে।
অল নিউজ (All News) ও আরটিনিউজ২৪ (RT News24) নামের পেজ দুটি ঘুরে এমন আরও বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া যায়। এসব ভিডিওর কোনো কোনোটিতে শেখ হাসিনাকে ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী তার ভূমিকা নিয়ে ভিডিও বার্তায় কথা বলতে দেখা যায়। এ ভিডিও বার্তায় তিনি তার অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছেন। আরেকটি ভিডিওতে শেখ হাসিনা পরিমনির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
ভিডিওগুলো এমনভাবে তৈরি যে এগুলোতে থাকা ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বর, ঠোঁটের নড়াচড়া, অঙ্গভঙ্গি দেখে আপাত মনে হবে আসলেই তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু যাচাইয়ে দেখা যাচ্ছে, এসব ভিডিওগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি, যা কখনো ভিডিওগুলোর শেষে ডিসক্লেইমার থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে আবার কখনো ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুসন্ধানে ধরা পড়ছে।
টাকা পেয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ানোর দাবিতে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত সংস্করণটি দেখুন এখানে।
ফ্যাক্টচেকাররা এসব ভিডিও কেন রেট করে
এই প্রতিবেদনটির সূচনায় চলে যাই আবার। অল নিউজ (All News) ও আরটিনিউজ২৪ (RT News24) নামের ফেসবুক পেজ দুটি পিনাকী ভট্টাচার্যের একটি সম্পাদিত ভিডিও দিয়ে দাবি করে যে, ফ্যাক্টচেকাররা পক্ষপাতদুষ্টু এবং ডিসক্লেইমার থাকা সত্ত্বেও তাদের কাল্পনিক কনটেন্ট ফ্যাক্টচেকাররা রেট করেছে।
ফ্যাক্টচেকারদের রেট করা ওই কনটেন্টটি যাচাই করে দেখা যায়, ভিডিওটির শেষে এটি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি সে ব্যাপারে ডিসক্লেইমার থাকলেও পোস্টটির ক্যাপশনের উপস্থাপন ছিল বিভ্রান্তিকর। এ ক্যাপশন থেকে বুঝার কোনো উপায় ছিল না যে, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি। পোস্টটির ক্যাপশন ছিল, ‘হাসিনার স্বীকারোক্তি-কীভাবে আয়নাঘর তৈরি হলো, কীভাবে নির্যাতন ও ভয়ের মাধ্যমে আয়নাঘরে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়।’
এই ক্যাপশন থেকে বুঝার উপায় নেই যে, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি। সঙ্গত কারণেই এমন ক্যাপশন থেকে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ আছে। যা কনটেন্টটি রেট করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে মেটার থার্ড পার্টি পার্টনার ফ্যাক্টচেকারদের সহযোগিতা করে।
ফ্যাক্টচেকারদের সমালোচনা করে তৈরি পিনাকীর সম্পাদিত ভিডিওটিতেও এ বিবেচনায় রেটিং যোগ্য যে, এখানে কোনো ডিসক্লেইমার বা এমন কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি, যাতে বুঝা যায় এটি এআই দিয়ে তৈরি।
প্রসঙ্গত, এই ধরনের কনটেন্ট ফেসবুকে শেয়ারের ক্ষেত্রে মেটার ‘এআই লেবেল‘ নামে একটি ফিচার রয়েছে। ডিসক্লেইমারের পাশাপাশি এই ফিচার ব্যবহার করলেও সেটি যে এআই দিয়ে তৈরি তা বুঝার সুযোগ রয়েছে।
ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এমন অডিওযুক্ত ভিডিও কিভাবে শনাক্ত করবেন
এ ধরনের অডিও সম্পর্কে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের ইনোভেশন টিমের মিডিয়া ও কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ আন্না শিল্ড বলেন, ‘একটি ডিপফেক ভিডিও তৈরি করতে যে পরিমাণ ডেটা ও প্রযুক্তির প্রয়োজন, সে তুলনায় স্বল্প ডেটা ও প্রযুক্তি দিয়েই প্রায় বাস্তব অডিও তৈরি করে ফেলা সম্ভব।’
অডিও ডিপফেক তৈরি করা তুলনামূলক সহজ হলেও এটি শনাক্ত করা কঠিন। জার্মানির ফ্রাউনহোফার ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লায়েড অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড সিকিউরিটির মেশিন–লার্নিংয়ের প্রকৌশলী নিকোলাস মুলার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘ভিডিও ডিপফেকের চেয়ে অডিও ডিপফেক শনাক্ত করা একটু বেশি কঠিন, কারণ এ ধরনের অডিও শনাক্তে আমাদের কাছে খুব কম ক্লু থাকে।’
মুলার বলেন, একটি ভিডিও ফুটেজে অডিও, ভিডিও থাকে এবং এ দুইয়ের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে। যার মাধ্যমে শনাক্ত করা যায় ভিডিওটি ভুয়া না বাস্তব। কিন্তু অডিওর ক্ষেত্রে এ ধরনের উপাদান খুবই কম থাকে। ডিপফেক অডিও শনাক্তের একটি কৌশল হতে পারে, অডিওতে ব্যক্তির কথা বলার ধরন যাচাই করা। যেমন, সন্দেহজনক অডিওটির সঙ্গে একই ব্যক্তির পূর্বের কথোপকথনের রেকর্ড তুলনা করা। শব্দ উচ্চারণের ধরন, বিরতি, শ্বাস–প্রশ্বাসের ধরন, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ ইত্যাদি বিষয় তুলনা করে সন্দেহজনক অডিওটি যাচাই করা যেতে পারে।
এর বাইরে সন্দেহজনক অডিওর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও প্ল্যাটফর্ম অনুসরণের পরামর্শ দেয় ডয়েচে ভেলের ফ্যাক্টচেক বিভাগ।
সর্বোপরি, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সামনেই একটি জাতীয় নির্বাচন অপেক্ষা করছে। বিগত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, নির্বাচনী সময়ে দেশে বিদ্যমান বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের যে পরিবেশ থাকে, তাতে একটি ভূমিকা থাকে ডিপফেক ভিডিওর।
দেশের চারটি পেশাদার ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে ফ্যাক্টওয়াচের একটি গবেষণায় দেখা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের যে পরিবেশ ছিল, তাতে ডিপফেইক ভিডিওর ভূমিকা ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ ধারা আরও বৃহৎ পরিসরে আসতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তাই বিনোদন বা নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে এমন ভিডিও তৈরি করলে সেটির উপস্থাপনে ডিসক্লেইমার দিয়ে দেওয়া, বিভ্রান্তিমূলক উপস্থাপন এড়িয়ে চলা ও ফেসবুকের এআই নীতিমালা মেনে চলা উচিত। আর না মানা হলে এসব ভিডিও বা কনটেন্ট পড়বে ফ্যাক্টচেকের আওতায়।