কোনো শক্তির উৎস ছাড়াই অবিরাম বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালানোর একটি ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এভাবে অবিরাম বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া সম্ভব না। চটকদার শিরোনামের কারনে সাধারন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই ভিডিও দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
গুজবের উৎস
নাটোর সময় পেজ থেকে গত ১৫ই সেপ্টেম্বর এই ৩ মিনিট ১ সেকেন্ড এর এই ভিডিওটি আপলোড করা হয় । কিছুদিনের মধ্যেই ১৫ হাজার ফেসবুক ব্যবহারকারী এই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন ।
আরবিভাষী এই ফেসবুক পেজ থেকে গত ৮ই সেপ্টেম্বর এই ভিডিওটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
ভিডিও বিশ্লেষণ
ভিডিওতে প্রথমে দেখানো হয়, একটি কাঠের বোর্ডে উপরে উপরে ক্ষুদ্রাকার একটি বৈদ্যুতিক বাতি এবং মোটর সহ ফ্যান স্থাপন করা হয়েছে। এরা বৈদ্যুতিক তার দিয়ে একে অপরের সাথে সংযুক্ত , এবং এই তারের প্রান্তভাগ একটি গোলাকার চুম্বকের সাথে প্যাচানো রয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি চুম্বক এই প্রথম চুম্বকের কাছাকাছি আনা হলেই বাতি জ্বলে উঠছে, ফ্যান ঘোরা শুরু করছে। আবার দ্বিতীয় চুম্বকটি দূরে সরিয়ে নিলেই বাতি, পাখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ভিডিওর দ্বিতীয় অংশে ( ৫ সেকেন্ড থেকে ২ মিনিট ৪৪ সেকেন্ড) কিভাবে এই যন্ত্রটি তৈরি করতে হবে, সেটা দেখানো হল। এখানে কাঠের বোর্ড, স্পার্ক প্লাগ, বৈদ্যুতিক বাল্ব, মটর ,পাখা ,চুম্বক এবং বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে এই ডেমোনেস্ট্রেশন এর এক পর্যায়ে প্রথম চুম্বকের নিচে ২ টি কালো তার দেখতে পাওয়া যায়।
ভিডিওর তৃতীয় অংশে কাঠের বোর্ডটি উলটে নিচের অংশে সংযুক্ত তার দেখানো হয়েছে। একই সময়ে পুনরায় চুম্বক কাছাকাছি এনে এবং দূরে নিয়ে দেখানো হয়েছে যে চুম্বকের সাথে বাতি জ্বলার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং তারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং পুনরায় সংযোগ দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে এই তারের সংযোগ ( যা একটি সুইচ এর মত কাজ করছে) এর সাথে আলো জ্বলার সম্পর্ক রয়েছে।
ভিডিওতে কাউকে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি ।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
অনেক দর্শক ফ্রেমের বাইরের ব্যাটারি বা বিদ্যুৎ উৎসের কথা নির্দেশ করে কমেন্ট করেছেন । ( যে ব্যাটারিটা ক্যামেরায় দেখানো হয়নি)
এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, ,দ্বিতীয় চুম্বকটা প্রথম চুম্বকের কাছে আনার সময়েই বাইরে থেকে কেউ একজন সুইচ চাপ দিয়ে (কিংবা তারে সংযোগ দিয়ে) বিদ্যুৎ বর্তনী সম্পূর্ণ করা হত। যার ফলে বাতি জ্বলত, পাখা ঘুরতো। এখানে চুম্বকের কোনো সম্পর্ক নেই।
ম্যানুয়ালি,হাত দিয়ে সুইচ না চেপে এখানে ম্যাগনেটিক রিড সুইচ ব্যবহৃত হতে পারে। তবে এই অংশটা ক্যামেরায় যেহেতু ক্যামেরায় দেখানো হয়নি, তাই নিশ্চিত হওয়ার উপায় নাই।
একই কারনে, যেহেতু এই মেকানিজম ক্যামেরায় দেখানো হয়নি তাই অনেক দর্শক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে ভাবছেন, এভাবে একটি যন্ত্র বানিয়ে বিনা খরচে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
কমেন্টে এই যন্ত্র কেনার জন্য কেউ কেউ দাম ও জিজ্ঞাসা করছেন।
এই যন্ত্রের সম্ভাব্য কলাকৌশল জানার জন্য ফ্যাক্টওয়াচ কথা বলেছে প্রকৌশলী তানভির হাসান এর সাথে । তিনি এই ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে বলেছেন, বোর্ড এর উপরে সাদা ২ টা বস্তু হচ্ছে ইঞ্জিন এর স্পার্ক প্লাগ। উপরে যে তার যুক্ত করেছে, সেটার কানেকশন বোর্ডের নিচে চলে গেছে এই স্পার্ক প্লাগ দিয়ে । এখানে লাল তার এবং নীল/কালো তারের মধ্যে বাতি আর ফ্যান প্যারালাল কানেকশন দেওয়া । তার মানে হচ্ছে, লাল আর নীল এর মধ্যে কোনো ভোল্টেজ দিলে লাইট ফ্যান চলবে। এখন দেখুন, স্পার্ক প্লাগ দিয়ে তারের কানেকশন বোর্ডের নিচে নিয়ে গেছে । এরপর বোর্ড এর নিচে ২ টা স্পার্ক প্লাগ এর মধ্যে , সম্ভবত, একটা ব্যাটারি আর একটা রিড সুইচ যুক্ত করে দিয়েছে। দ্বিতীয় চুম্বক কাছে আনলে রিড সুইচ এক্টিভেট হচ্ছে ,যার জন্য ২ টা স্পার্ক প্লাগ ( লাল ও নীল তারের মধ্যে) ব্যাটারি ভোল্টেজ দিচ্ছে । তখন মোটর, লাইট চলতেছে।
২ মিনিট ১০ সেকেন্ড এর দিকে বোর্ড এর নিচের অংশটা দেখিয়েছে । কিন্তু ওখান থেকে কন্টিনিউয়াস শট এ চুম্বক দিয়ে ফ্যান,লাইট চালায়নি। মাঝে ভিডিওতে ছেদ আছে। এবং সেই ভিডিওর কাট করা সময়ের মাঝেই ,আমার ধারনা, বোর্ডের নিচে ব্যাটারি ও রিড সুইচ লাগিয়েছে ( যেটা ক্যামেরাতে দেখানো হয়নি) ।
এছাড়া ২ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের পরে যে তার খোলা,লাগানো দেখাল, সেটা আইওয়াশ মাত্র । স্পার্ক প্লাগ এর পরবর্তী অংশে যোগ করা চুম্বক এবং তার সবই অপ্রয়োজনীয়। তবে শেষ দিকে রিড সুইচ ছাড়াই ম্যানুয়ালি তার যুক্ত করে হাত দিয়ে তারের কানেকশন খুলে বা বন্ধ করে লাইট জ্বলা নেভা দেখিয়েছে।
এখানে, মূল কারসাজি নিহিত রয়েছে ব্যাটারি লুকানোর মধ্যে । এ ধরনের সকল পারপেচুয়াল মোশন মেশিনের উদ্ভাবকরাই কোনো না কোনো উপায়ে তাদের ব্যাটারি লুকায়। আমি এমন প্রজেক্ট ও দেখেছি, যেখানে বড় মটরের মধ্যেই ব্যাটারি লুকিয়েছিল।
প্রকৌশলী মনিফ শাহ চৌধুরী ফ্যাক্টওয়াচ কে জানান , এভাবে কখনোই নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। বিষয়টা এমন হয়ে গেল যে আমি এক মগ পানি একটা বালতিতে ঢেলে আশা করছি বালতি থেকে প্রতি সেকেন্ডে এক মগ সমান পানি তৈরী হতে থাকবে। বিষয়টা পুরোটাই মিথ্যা এবং ধোকাবাজি।
এখানে দুটো বিষয় হতে পারে। এক, বোর্ডের নিচ দিয়ে লাইট আর ফ্যানের লাইন অন্য কোনো পাওয়ার সোর্সের সাথে কানেক্ট করা আছে। ভিডিওর বাইরে থেকে অন্য কেউ সেই সুইচ অন অফ করছে।
অথবা, অন্য কেউ না থাকলেও ম্যাগনেটিক রিড সুইচের মাধ্যমে একই কাজ করা সম্ভব। যখনই চুম্বক কাছে আসছে, পাওয়ার সোর্সের সুইচ অন হয়ে যাচ্ছে এবং লাইট/ফ্যান চলছে।
———–
প্রকৃতপক্ষে , এভাবে কোনো ইনপুট ব্যয় না করে অবিরাম শক্তির আউটপুট পাওয়া সম্ভব নয়। এটা তাপগতিবিদ্যার মৌলিক সূত্রকেই লংঘন করে। তাপগতিবিদ্যার ১ম সূত্র অনুযায়ী, সকল ক্ষেত্রে যেখানে তাপের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করা হয় সেখানে, গৃহীত তাপ কৃত কাজের সমানুপাতিক; বিপরীতভাবে, সমান পরিমাণের কাজ সমান শক্তি উৎপন্ন করে। কিন্তু পারপেচুয়াল মোশন মেশিন অনুযায়ী ইনপুট হচ্ছে ০, আউটপুট ধরুন ৫০ ওয়াট, যেটা সম্ভব নয়।
তাপগতিবিদ্যার ২য় সূত্র অনুযায়ী, এমন কোনো ইঞ্জিন তৈরি সম্ভব নয়, যেটা কোনো বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করে অবিরত কাজে পরিণত করবে অথচ পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হবে না। এই রকম কিছু হতে হলে পরিবেশের চেঞ্জ হবেই (বাতাস থেকে হয়তো তাপ গ্রহণ করবে, ফলে এনভায়রনমেন্ট শীতল হবে) কিন্তু পারপেচুয়াল মোশন মেশিনের শর্তে এমন কিছু উল্লেখ করা নাই। সুতরাং বাইরে থেকে কোনো শক্তি না নিয়ে ওই ধরনের মেশিন বানানো অসম্ভব।