সম্প্রতি “নতুন আইন: নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় গেটে দাঁড়াতে পারবে না হেল্পার” শিরোনামে একটি খবর ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে শিরোনামে করা দাবিটি মিথ্যা। বর্তমান আইন “সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮”-এ গণপরিবহনে যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শাস্তিস্বরূপ কোন বিধিনিষেধ কিংবা আইন নেই। জানা যায়, ২০২০ সালের একটি পুরনো খবরের শিরোনাম বিকৃত করে নতুন আইনের নামে উক্ত অসত্য তথ্যটি প্রচার করা হচ্ছে।
“নতুন আইন: নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় গেটে দাঁড়াতে পারবে না হেল্পার” খবরটি ‘newsbhai24.com’, ‘ajkbd.com’সহ একাধিক অনলাইন পোর্টালের বরাত দিয়ে ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানেএখানেএখানেএখানেএখানেএখানেএখানে ও এখানে।
প্রতিবেদনগুলোর শিরোনামে নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় হেল্পার গেটে দাঁড়াতে পারবে না এমন দাবি করা হলেও বিস্তারিত অংশে দাবির পক্ষে কোন তথ্য-প্রমাণ দেয়া হয়নি। আইনটি প্রণয়নের তারিখ কিংবা কোন আইনের ধারায় সেটি যুক্ত করা হয়েছে এ সকল তথ্যও প্রতিবেদনে নেই। উক্ত আইন সম্পর্কে দেশীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো থেকেও কোন সংবাদ প্রকাশ করা হয়নি।
প্রতিবেদনের কিছু অংশ গুগল সার্চ করে দেখা যায়, গত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে ‘Thedailycampus’-এ প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে লেখাটি পুরোপুরি কপি করা হয়েছে।
মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, টিম পজিটিভ বাংলাদেশ (টিপিবি) দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে “গণপরিবহনে নারী যাত্রী ওঠা এবং নামার সময় হেল্পার/কন্ডাকটর কোনভাবেই গেটে দাঁড়াতে পারবে না” এই মর্মে আইন করে প্রজ্ঞাপন জারির আহবান জানিয়েছে। ‘নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় হেল্পার গেটে দাঁড়াতে পারবে না” শিরোনামে ‘Thedailycampus’ -এর প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
০৩ সেপ্টেম্বর “Team Positive Bangladesh – TPB” ফেসবুক পেজ থেকেও এ প্রসঙ্গে একটি পোস্ট করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সামাজিক সংগঠন “টিম পজিটিভ বাংলাদেশ (টিপিবি)” বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে ২০১৯ -এ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পোস্টটি দেখুন এখানে
মূলত ‘Thedailycampus’ প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই অন্যান্য অনলাইন পোর্টাল বিভিন্ন সময়ে খবরটি পুনর্প্রকাশ করে। চলতি বছরের মে মাসে ‘passengervoice.net’ এবং জুন মাসে ‘update.com.bd’ নামের ওয়েবসাইটগুলো একই সংবাদ করেছিল। তবে লক্ষণীয় যে, শিরোনামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে “নতুন আইন” শব্দ দুটি এর আগে কোন পোর্টাল লেখেনি।
বাংলাদেশে গণপরিবহনে যৌন হয়রানির চিত্র ও আইন
দেশীয় পত্র-পত্রিকায় নানা সময় গণপরিবহনে নারীর ‘ভোগান্তি’ এবং ‘যৌন হয়রানি’র বিষয়টি আলোচিত-সমালোচিত হয়ে এসেছে। নিত্যদিনের যাতায়াতকালে নারী যাত্রীদের তিক্ত ও ভীতিকর অভিজ্ঞতা যেন নিয়মিত ঘটনা। গণপরিবহনে একাধিক যৌন হয়রানির ঘটনা নিয়ে ১৯ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত বাংলাট্রিবিউনের “গণপরিবহনে যৌন হয়রানি, প্রতিকার কী?” শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে নারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ নামের একটি সামাজিক ক্যাম্পেইন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। বিস্তারিত পড়ুন ডয়েচে ভেলের “গণপরিবহনে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, যৌন নিপীড়ন কি বন্ধ হবে?” প্রতিবেদনে। সে বছরে গণপরিবহনে মোট ৫৯ জন নারী ধর্ষণ ও যৌননির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক” শীর্ষক গবেষণা বলছে, দেশে গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্যান্যভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গণপরিবহন ব্যবহারকারী নারীদের শারীরিক যৌন হায়রানির মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো, আস্তে ধাক্কা দেওয়া, চুল স্পর্শ করা, কাঁধে হাত রাখা, হাত, বুক বা শরীরের অন্য স্পর্শকাতর অংশে স্পর্শ করা ইত্যাদি। ব্রাকের ওয়েবসাইটে “94% women victims of sexual harassment in public transport” শিরোনামে নিবন্ধটি পড়ুন এখানে।
২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রথম বারের মত গণপরিবহনে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ৩০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের বিধান করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত হয়, বড় বাসে ৯টি, মিনিবাসে ছয়টি এবং বিআরটিসি বাসে ১৪টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। প্রায় একইভাবে বহুল আলোচিত নতুন ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’-এ বলা আছে, “কর্তৃপক্ষ বা যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ কমিটি গণপরিবহনের নারী, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের জন্য আসন সংখ্যা নির্ধারণ করতে পারবে।” কিন্তু সেখানে গণপরিবহনে যৌন নির্যাতন বা হয়রানি প্রতিরোধে কোন আইন রাখা হয়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালে হাইকোর্ট ১১টি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন এবং সংসদে আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত আদালতের এই নির্দেশ পালন করতে হবে বলে রায় দেন। কিন্তু ১২ বছরেও এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন আইনের তথ্যশালা “Chancery Law Chronicles” -এ যৌন হয়রানি সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশিকাটির সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের সুবিধার্থে “High Court Division’s Landmark Directives on Sexual Harassment in Bangladesh is added to CLC Database” শীর্ষক নিবন্ধের কিছু অংশ বাংলায় তর্জমা করে দেয়া হল:
বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার ইতিহাসে ১ মে ২০০৯ একটি উল্লেখযোগ্য দিন; এইদিন সর্বোচ্চ আদালতের উচ্চ আদালত বিভাগ কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাস্তাঘাটসহ দেশের অন্যান্য পাবলিক প্লেসে নারী, মেয়ে এবং শিশুদের যেকোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানিমূলক অপকর্ম রোধে এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে কিছু নির্দেশনা জারি করেন। উচ্চ আদালত সরকারকে এই নির্দেশনাগুলোর ভিত্তিতে আইন তৈরির নির্দেশ দেন এবং রায়ে জানানো হয়, সংসদে আইন প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত আদালতের এই নির্দেশিকাটি আইন হিসাবে গণ্য করা হবে।
“May 13, 2009 is one of the noteworthy days in the legal history of Bangladesh since the High Court Division of the Supreme Court issued a set of guidelines defining sexual delinquency to prevent any kind of physical, mental or sexual harassment of women, girls and children at their workplaces, educational institutions and other public places including roads across the country. The HC directed the government to make a law on the basis of the guidelines, and ruled that the guidelines will be treated as a law until the law is made.”
‘Chancery Law Chronicles (CLC)’ -এর তথ্যশালায় আপনার রেজিস্ট্রেশন করা থাকলে সম্পূর্ণ রায়টি পড়তে পারবেন এখানে।
ফ্যাক্টওয়াচের রায়
অর্থাৎ, চলমান আইন ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ -এ গণপরিবহনে নারীর যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শাস্তি বিষয়ক কোন আইন নেই। ১ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে কার্যকর হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আইনটির কোন সংশোধন বা পরিমার্জন ঘটেনি। গত বছর প্রকাশিত একটি সংবাদের মূল উদ্দেশ্য বিকৃত করে ‘নতুন আইনঃ নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় গেটে দাঁড়াতে পারবে না হেল্পার’ শিরোনামে তথ্যটি প্রচার করা হয়েছে ফেসবুকে যা অসত্য।
এছাড়া, ১ মে ২০০৯ তারিখে সর্বোচ্চ আদালতের উচ্চ আদালত বিভাগ কর্তৃক জারি করা নির্দেশিকাগুলো এখন পর্যন্ত আইন হিসেবে পাশ হয় নি। যদিও সেখানেও ‘নারী যাত্রী ওঠা-নামার সময় গেটে দাঁড়াতে পারবে না হেল্পার’ এমন সুনির্দিষ্ট কোন নির্দেশনা আছে কিনা জানা যায়নি। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এ সংক্রান্ত কোনো আইন পাশ হয় নি।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?