এটি সাঈদীর অপারেশনের ভিডিও নয়

71
এটি সাঈদীর অপারেশনের ভিডিও নয়
এটি সাঈদীর অপারেশনের ভিডিও নয়

জহিরুল ইসলাম

Published on: [post_published]

যা দাবি করা হচ্ছে : একটি অপারেশন থিয়েটারে কোনো একজন রোগীর অপারেশনের ভিডিওর অংশ দেখিয়ে দাবি করা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে এই অপারেশন চলাকালীন শহীদ করা হয়েছে।

যা পাওয়া যাচ্ছে : ভিডিওটি দিল্লীর আর্টেমিস হাসপাতালের লিভার টান্সপ্লান্ট এর একটি অপারেশনের ভিডিও, যা ৬ বছর আগে ইউটিউবে আপলোড করা হয়েছিল।

গুজবের উৎস

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওযুক্ত কয়েকটি পোস্ট দেখতে পাবেন এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে,এখানে ,এখানে,এখানে


‘হাওয়ার সাথে চলি’ আইডি থেকে ২ মিনিট ৯ সেকেন্ড দৈর্ঘ্যের এই ভিডিও পোস্ট করে ক্যাপশনে বলা হয়েছে, কিভাবে সাঈদি সাহেব কে অপারেশন চলাকালীন শহীদ করা হয়েছে,ভিডিও দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি

এই ভিডিওর প্রথম ১ মিনিট ৫ সেকেন্ড সময় জুড়ে কোনো একটি অপারেশন থিয়েটার দেখানো হয়, যেখানে ৩ জন সার্জন অপারেশন থিয়েটার এর যথাযথ পোষাক-পরিচ্ছদ পরিহিত অবস্থায় কোনো একজন শায়িত রোগীর একটি সার্জারি করছেন। এছাড়া কক্ষে আরো ২ জন ( সম্ভবত এ্যানেস্থেশিস্ট অথবা সহকারী) কে দেখা গিয়েছে। পুরো সময়ে কখনো রোগীর মুখ দেখা যায়নি। ভিডিওর বাদবাকি সময়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পূর্বের এবং পরের কিছু ফুটেজ দেখানো হয়।

অনুসন্ধান

রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, এই ভিডিওটি Liver Transplant & Gastro Sciences Artemis Hospital নামক ইউতিউব চ্যানেল থেকে ২০১৮ সালের ২৮শে এপ্রিল আপলোড করা হয়েছিল । ভিডিওর ক্যাপশন ছিল Liver Transplant Operation Theatre at Artemis Hospital , Gurgaon , Delhi NCR, India । ভিডিওর ডেসক্রিপশনে লেখা ছিল A ringside view of the Liver Transplant Modular OT Liver Transplant Surgeons :
Dr Ramdip Ray
Dr Giriraj Bora
Dr Shyam Mahansaria
Dr Md Sudheer
Dr Jevin George

এখানে ভিডিওর দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩৯ সেকেন্ড, কিন্তু ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে অপারেশন থিয়েটারের অংশের দৈর্ঘ্য ৬৫ সেকেন্ড। ভালভাবে পর্যবেক্ষণের পর বোঝা গেল,ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি স্লো মোশনে চালিয়ে দৈর্ঘ্য বেশি করা হয়েছে। দু’টি ভিডিওতেই প্রধান উপাদানগুলো ( অপারেশন থিয়েটারের ডিজাইন, ডাক্তারদের সংখ্যা,উপরের বড় বাতি, কাটাকাটির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ, ব্যাকগ্রাউন্ড এর শব্দ  ইত্যাদি) সবই হুবহু মিলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, আর্টেমিস হাসপাতালের এই অজ্ঞাত রোগীর সার্জারিরি ভিডিওই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

আর্টেমিস হাসপাতাল সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, এটি ভারতের নয়া দিল্লীর গুরগাও তে অবস্থিত একটি বেসরকারি হাসপাতাল, যা ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। Liver Transplant & Gastro Sciences Artemis Hospital ইউটিউব চ্যানেলটিতে মাত্র ৮ টি ভিডিও আপলোড করা হয়েছিল, যার সবগুলোই ২০১৮ সালে।

অন্যদিকে, ‘’ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে” এমন অভিযোগে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ তারিখে দায়েরকৃত বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর মামলার প্রেক্ষিতে ঐ বছর ২৯ জুন তারিখে রাজধানীর শাহীনবাগের বাসা থেকে পুলিশ দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে গ্রেপ্তার করে।  পরে ওই বছরের ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, নির্যাতন ও ধর্মান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। পরে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। আপিলের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেন ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সেই রায়ে সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এরপর দীর্ঘদিন তিনি কারাগারে ছিলেন। ] ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট রবিবার তিনি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে তাকে কারাগার থেকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট  ৮৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “গত ১৩ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ইমারজেন্সি বিভাগে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আনিত রোগী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী (৮৪) সাহেবের ভর্তি শুরু হইতে পরবর্তী সকল চিকিৎসা বিধিসম্মতভাবে আন্তর্জাতিক প্রাকটিস অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়। তার চিকিৎসায় অত্র হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট সকল চিকিৎসা দানকারী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকরা সঠিকভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন। পরদিন ১৪ আগস্ট বিকেল ৬টা ৪৫ মিনিটে তার সাডেন কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়। তার অ্যাডভান্স কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা চলতে থাকে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান।“

ঢাকার বিএসএমএমইউ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রেজাউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন,  সেদিন রাত ৮টা ৪০ দ্বিতীয়বারের মত তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল।

তবে কারাগারে থাকাকালীন ২০১৮ সালে বা তার কাছাকাছি সময়ে কখনো তাঁর শরীরে কোনো অপারেশনের কথা গণমাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সঙ্গত কারনে ফ্যাক্টওয়াচ এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোকে ‘মিথ্যা’ সাব্যস্ত করছে ।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সম্পর্কিত আরো কিছু পুরনো গুজব দেখতে পাবেন এখানে-

১। সাঈদীর অসুস্থতার দাবিতে পুরনো ছবি ভাইরাল

২। সাঈদীর মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়েছেন কোনো পুলিশ সদস্য?

৩। সাঈদীর মৃত্যুতে কাবা শরীফের প্রধান ইমাম টুইটারে শোক বার্তা দিয়েছেন?

৪। সাঈদীর মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়েছে মহাকাশ সংস্থা নাসা?

৫। সাঈদীর গায়েবানা জানাজা কাবা শরীফে পড়ার অনুমোদনের দাবিতে ভূয়া ভিডিও

৬। শেখ মুজিব ও সাঈদীর জানাজার বিভ্রান্তিকর তুলনা

৭। লাশবাহী এই অ্যাম্বুলেন্সে সাঈদীর মরদেহ ছিল না

৮। কাবা শরীফের ভেতর থেকে সাঈদীর বের হবার ছবিটি বিকৃত

৯। “একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকার সাঈদীর মৃত্যু” শীর্ষক ফটোকার্ডটি প্রথম আলো-র নয়

১০। ১৯৭১ সালের এই ছবিটা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নয়

১১। ফিলিস্তিনের শিশু শিল্পী গানে গানে সাঈদীর মুক্তি দাবি করে নি

১২। “ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হচ্ছে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে” – দাবিটি বিভ্রান্তিকর

১৩। ‘সম্পূর্ণ বিনা দোষেই আল্লামা সাঈদী কারাগারে’ – ভূয়া দাবি

১৪। ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি হলো দেলওয়ার হোসেন সাঈদী- ডিবিসি নিউজের নামে ভুয়া ফটোকার্ড

১৫। ‘‘এপ্রিল ফুল” দিবসে ৭ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল?

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh