পৃথিবীর গভীরতম গর্তে জাহান্নামের চিৎকারের শব্দ!- এমন শিরোনামে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে , এটি একটি আন্তর্জাতিক গুজব। গত ৩৩ বছর ধরেই বিভিন্ন দেশে , বিভিন্ন ভাষায় এই গুজবটা ছড়িয়েছে। তবে এর কোনো সত্যতা কখনো পাওয়া যায়নি। রাশিয়ায় বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য খনন করা একটি কূপ থেকেই এই গুজবের উৎপত্তি।
গুজবের উৎস
বাংলায় এই ভিডিওটি সর্বপ্রথম পাওয়া যাচ্ছে The Daily Moment নামের একটি পেইজ থেকে। ভিডিওটি পাবেন এখানে। মে মাসের ১৪ তারিখে আপলোড হওয়া ভিডিওটি প্রায় ১২ মিলিয়ন লোক দেখেছেন, ৩০ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে, এবং অন্যান্য ফেসবুক পেইজ থেকেও আপলোড করা হয়েছে।
Ma’hadut Tanyeem – মা’হাদুত তানঈম” একাউন্ট থেকে এই ভিডিও আপলোড করে– ২৫শে মে তারিখে।
M.N.Siddiki নামের পেইজ আপলোড করেছে এখানে, আলোর দ্বীন নামের পেইজ আপলোড করেছে এখানে।
তবে এই দাবিটি বাংলায় The Daily Moment এরও আগে ২০১৯ সালে মুফতি কাজী ইব্রাহিম এই দাবিটি প্রথম করেছিলেন, দেখুন এখানে। তবে তিনি দাবি করেছিলেন, ২০০৬ সালে সাইবেরিয়াতে এই শব্দ রেকর্ড করা হয়েছিল।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান
১৯৭০ সাল সোভিয়েত ইউনিয়নের কোলা উপদ্বীপে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য একটি কূপ খনন শুরু হয়। ৯ ইঞ্চি ব্যাসের একটি স্টিলের পাইপ এই কূপের মাধ্যমে মাটির গভীরে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন তেলের খনিতে এই ধরনের পাইপ ব্যবহার করা হয়।
২০ বছর চেষ্টার পরে শেষ পর্যন্ত কোলার সেই কূপের গভীরতা দাঁড়ায় ১২.২২৬ কিলোমিটার । এবং সেখানে বিজ্ঞানীরা শিলা গঠন, ভূগর্ভস্থ গ্যাস এবং পানির খোঁজ পান। সেখানে তাপমাত্রা ছিল ১৮০ ডিগ্রী।
এই গবেষণাকাজে বিজ্ঞানীরা অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি বা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনার মুখোমুখি হননি ।
কিন্তু ১৯৮৯ সালে ফিনল্যান্ড থেকে রাশিয়ার এই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিয়ে আলোচ্য গুজব তৈরি হয়। গুজবে দাবি করা হয়, আলাস্কায় এই পরীক্ষা করার সময় জনৈক মিস্টার আজাকভ হঠাত করে মাটির নিচে অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রমাণ পান। এ সময় তিনি সেখানকার টেকটোনিক প্লেট এর কম্পনের শব্দ রেকর্ড করতে গিয়ে অস্বাভাবিক শব্দ শোনেন । তার মতে, এটা ছিল লাখ লাখ মানুষের যন্ত্রণায় চিৎকারের শব্দ।
এরপর এই গল্পটা আরো রঙ চড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে । বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এবং সংবাদ্মাধ্যমে প্রচারিত হতে থাকে এটা। আমেরিকার Trinity Broadcasting Network (TBN) এর ১৯৮৯ সালের একটি পর্ব ( যার নাম ছিল “Scientists Discover Hell) তে এটা প্রচারিত হওয়ার পরে বিশ্বব্যাপীই গল্পটা জনপ্রিয় হয়ে যায়।
এই গুজবটি বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ধর্মের প্রচারের কাজে লাগানো হয়।
বিভিন্ন দেশে প্রচারের সময় গুজবটা কমবেশি বদলে যায়। যেমন-এই গুজবের অন্য এক ভার্সনে পাওয়া যায়, আলাস্কায় গভীর এক তেল কূপ খননের সময় নরক থেকে শয়তান বের হয়ে এসে ১৩ জন অয়েল রিগ কর্মীকে খুন করেছিল!
উইকিপিডিয়ায় Well to Hell Hoax অর্থাৎ নরকের কূপের গুজব নামক ভুক্তিতে এই ঘটনাপ্রবাহ বর্ণিত হয়েছে।
ভাইরাল ভিডিওতে বর্ণিত কয়েকটা দাবি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
দাবি ১- বাংলা ভাষায় করা ভিডিওতে ন্যারেটর দাবি করে যে রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা ৬,৭০০ কিলোমিটার গভীর গর্ত করেছিল, এবং সেখানে অণুজীব পাওয়া গেছে।
খন্ডনঃ
পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬,৩৭৮ কিলোমিটার। বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনে এর চেয়ে বেশি গর্ত করার কোনো প্রয়োজনই নেই।
আমরা যদি ধরেও নেই ন্যারেটর ৬,৩৭৮ কিলোমিটার বলতে চেয়েছিলেন, সেখানে অণুজীব পাওয়া সম্ভব না, কারণ পৃথিবীর কেন্দ্রের কাছে তাপমাত্রা ৪,৪০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে ৬,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ন্যারেটরের দাবি ছিল সেখানে অণুজীব পাওয়া গেছে, কিন্তু এই তাপমাত্রায় আমাদের কোনো যন্ত্র কাজ করবে না, উত্তাপের জন্য, এবং সেখানে কোনো প্রাণ থাকাও সম্ভব না! মূলত ,১২ কিলোমিটার গভীরে যাওয়ার পথে অল্প গভীরতায় (৬.৭ কিমি গভীরে) অনুজীব পাওয়া গিয়েছিল।
Kola Superdeep Well এর ওয়েবসাইটে এসব তথ্য আছে (রাশিয়ান ভাষায়, অনুবাদ দেখুন নিচে)।
দাবি ২-বিজ্ঞানী দল দাবি করেছেন তারা চিৎকার শুনতে পেয়েছে।
খন্ডনঃ
এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি । কূপের মধ্যে শব্দ রেকর্ড করার কোনো ডিভাইস পাঠানো হয়েছিল-এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যাচ্ছেনা। এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী নিজের নাম পরিচয় প্রকাশ করে জনসমক্ষে এমন কোনো কথা জানান নি।
দেখুন ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা স্নোপস এর বিশ্লেষণ এখানে।
দাবি ৩- সেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা, তবে কোনো শিশুর আওয়াজ পাওয়া যায় নি। বেশিরভাগ চিৎকারই ছিল নারীদের!
খন্ডনঃ
অনুসন্ধানে জানা গেছে ভিডিওতে এবং মূল গুজবে ব্যবহৃত অডিওটি ১৯৭২ সালের সিনেমা Baron Blood থেকে নেয়া। আরো তদন্তে জানা গেছে অডিওক্লিপটি একটি ক্লিপকে বারবার (ল্যুপ) চালানো হয়েছে।
ব্যারন ব্লাড এর ভয়েস ক্লিপ এর সাথে গুজব এর অডিওর তুলনা দেখুন এখানে ।
মুফতি ইব্রাহিম এর ওয়াজ মাহফিলে প্লে করা অডিওটা শুনুন এখানে ।
সারমর্ম
মাটির নিচে জাহান্নামের দাবি একটি পুরোনো আন্তর্জাতিক গুজব । এই ভিডিওতে দাবি করা সকল তথ্যই অসত্য। তাই ফ্যাক্টওয়াচ এই পোস্টগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে।
তথ্যসূত্রঃ
Barbara Mikkelson, The Well to Hell, 31 December 1998, snopes.com
Brian Dunning, The Siberian Hell Sounds, Skeptoid Podcast #307