‘’শেকসপিয়ার আসলে শেখ যুবায়ের’’ কিংবা এই ধরনের ক্যাপশন সহযোগে ৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এই ভিডিওতে জনপ্রিয় ইসলামী বক্তা মুফতি ইব্রাহিম দাবি করছেন, ইংরেজি সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার প্রকৃতপক্ষে একজন আরব এবং তার নাম শেখ জুবায়ের। তবে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার জন্মগতভাবে খাঁটি ব্রিটিশ ছিলেন। আরব কিংবা অন্য কোনো অঞ্চল থেকে তার ইংল্যান্ডে অভিবাসনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বিভ্রান্তির উৎস
১৫ই সেপ্টেম্বর দুপুর থেকে ৯ সেকেন্ডের এই ভিডিও ক্লিপটি ভাইরাল হতে দেখা যায়। মূল ওয়াজ মাহফিলের সম্পূর্ণ ভিডিও ফ্যাক্টওয়াচ সংগ্রহ করতে পারেনি। তবে ৯ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘’শেকসপিয়ার, শেকসপিয়ার আসলে শেখ জুবায়ের। শেখ জুবায়ের ,ও এ্যারাবিয়ান । এ্যারাবিয়ান, আরবীয় আচল । তার মূল হইল আরবি।‘’
অনেকেই রসিকতা কিংবা ট্রল করে এই ভিডিওটা শেয়ার করেন। কিন্তু এই ভিডিওর বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে অনেক জায়গায় তর্ক-বিতর্ক করতে দেখা যায়।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পরিচয়
ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি এবং ইংরেজি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ার (William Shakespeare ) ১৫৬৪ সালে ইংল্যান্ডের ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির Stratford-upon-Avon নামক ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহন করেন। ১৬১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর বাবা জন শেক্সপিয়ার (১৫৩১-১৬০১) জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টির Snitterfield নামক গ্রামে।
জন শেক্সপিয়ার এর বাবা রিচার্ড শেক্সপিয়ার (১৪৯০-১৫৬১) জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারউইকশায়ার এর Wroxall নামক গ্রামে।
রিচার্ড শেক্সপিয়ার এর বাবা, জন শেক্সপিয়ার (১৪৬০-১৫২১) জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারউইকশায়ার এর Balsall নাম গ্রামে।
জন শেক্সপিয়ার এর বাবা থমাস শেক্সপিয়ার (১৪৩০-১৫১১) জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারউইকশায়ারের Wroxall নামক গ্রামে।
অর্থাৎ, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের পরিবার কমপক্ষে ৯ প্রজন্ম ধরে ইংল্যান্ডের ওই এলাকায় বসবাস করছিল।
মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকার আরবিভাষী কোনো দেশ থেকে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কিংবা তার পূর্বপুরুষদের কারো ইংল্যান্ডে অভিবাসনের কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়না।
মুফতি কাজী ইব্রাহিম
মুফতি কাজী ইব্রাহিম বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে এবং ইউটিউব ভিডিওতে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন । রাত ৯ টার পরে ঘরে লাইট জ্বালানো থাকলে ক্যান্সার হয়, পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন থাকে পায়ের গোড়ালিতে, ব্রয়লার মুরগি খেলে ছেলেরা সমকামী হয়ে যাবে, মাটির নিচে ৭ টি পৃথিবী আছে-যেখানে হিটলারের বাহিনী লুকিয়ে আছে, করোনার টিকার সাথে শরীরে মাইক্রোচিপ ধুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর বক্তব্য তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্য ওয়াজ মাহফিলে দিয়েছেন।
তার এসব বক্তব্য নিয়ে অন্যান্য ইসলামী চিন্তাবিদরা বিভিন্ন সময়ে সমালোচনাও করেছেন।
শেকসপিয়ার বিতর্কে কি বলছেন কাজী ইব্রাহিম ?
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কাজী মুফতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সেটি সম্ভবত ১০-১২ বছর আগের। আমি মাহফিলে যে বক্তব্য দিয়েছি, সেটি বলেছিলেন গাদ্দাফি। উনি বলেছিলেন আরবের যেসব পরিবার হিজরত করেছিল তাদেরই বংশধর। আমি গাদ্দাফির বক্তব্যেই শুনেছি। ইংরেজদের নামের পরিবর্তনের ধারায় শেকসপিয়ার নামটিও পরিবর্তন হয়েছে। যেমনটা পরিবর্তন হয়েছে ইসহাক থেকে আইজাক, ইবনে সিনা, এবেসিনা, ইউসুফ থেকে যোশেফ।“
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৯ সালে রেডিও তেহরান লিবিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বয়ানে খবর প্রকাশ করেছিল যে, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কোনো জন্মগতভাবে ইংরেজ নাগরিক নন। তিনি একজন আরব শেখ। তার নাম শেখ জুবায়ের বিন উইলিয়াম।
(রেডিও তেহরানের ওয়েবসাইটে এই খবরটা খুজে পাওয়া যায়নি। তবে রেডিও তেহরানের বরাত দিয়ে অন্য কয়েকটা ওয়েবসাইটে এই তথ্য পাওয়া গেল। যেমন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে )
লক্ষণীয়, মুয়াম্মার গাদ্দাফি স্বয়ং শেখ জুবায়ের/শেক্সপিয়ারকে আরব শেখ বলে দাবি করেছিলেন । ( An Arab sheik named Zubayr bin William, who had been born in the sixteenth century, was Shakespeare) কিন্তু কালের কণ্ঠ-কে দেওয়া সাক্ষাতকারে মুফতি ইব্রাহিম শেখ জুবায়েরকে আরব অভিবাসীদের বংশধর হিসেবে দাবি করছেন।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই শেকসপিয়ারের সাথে আরবের সংযোগ নিয়ে গুজব শুরু হয়। তবে মুয়াম্মার গাদ্দাফির ১৯৮৯ সালের বক্তব্যের পরেই এটা ব্যাপক প্রচারণায় আসে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইলিয়াম শেকসপিয়ার এর পরিচয় নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ( Conspiracy Theory) প্রচলিত আছে । অনেকে বলার চেষ্টা করেন, শেকসপিয়ারের নামে যা যা সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় , সেগুলো আসলে শেকসপিয়ারের লেখা নয়। ছদ্মনামে অন্য কেউ লিখেছে। প্রকৃত লেখকের দাবিদারদের মধ্যে ফ্রান্সিস বেকন, ক্রিস্টোফার মারলো, ড্যানিয়েল ডিফো, বেন জনসন, থমাস কিড, হেনরি পোর্টার, ওয়াল্টার র্যালে, রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, রাজা ষষ্ঠ জন, রাণী প্রথম এলিজাবেথ সহ অনেককেই শেকসপিয়ার হিসেবে দাবি করে অনেক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব রচিত হয়েছে।
উইকিপিডিয়ায় এমন ‘সম্ভাব্য শেকসপিয়ার’ হিসেবে ৮৭ জনের নামের একটি তালিকা রয়েছে, যাদেরকে বিভিন্ন সময়ে উইলিয়াম শেকস্পিয়ার হিসেবে দাবি করা হয়েছিল।
এমনকি তিনি পুরুষ নাকি মহিলা ,সেটা নিয়েও অনেক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব রয়েছে।
বলা বাহুল্য এদের কারো কোনো দাবিই ধোপে টিকেনি। উইলিয়াম শেকসপিয়ারকে কেউ অন্য কোনো লেখকের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে দেখাতে পারেনি।
এছাড়া, আরবি সাহিত্যে শেখ জুবায়ের নামেও কোনো লেখককে ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে খুজে পাওয়া যায়নি। মুয়াম্মার গাদ্দাফির দাবি অনুযায়ী, তিনি আরব থেকে অভিবাসী হয়ে ইংল্যান্ডে গমন করলে, তার আরবি এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই দক্ষতা থাকার কথা। সেক্ষেত্রে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে যে পরিমাণ সাহিত্য রচনা করেছেন, আরবিতেও তেমনিভাবে সাহিত্য রচনা করার কথা। নিদেনপক্ষে তার সাহিত্যে আরবি ভাষা, শব্দাবলী কিংবা আরবের জীবনযাত্রার ন্যুনতম প্রতিফলন থাকার কথা। সেরকমটা দেখা যায় না। অন্যদিকে, শেখ জুবায়েরের নামেও আমরা আরবিতে সে সময়ের কোনো সাহিত্যিকের সন্ধান পাই না।
ফ্যাক্টওয়াচের সিদ্ধান্ত
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার কে শেখ জুবায়ের কিংবা অন্য কোনো পরিচয়ে আড়াল করার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব। সেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের কথা শুনে, যাচাই বাছাই না করেই মুফতি ইব্রাহিম একটি ধর্মীয় সমাবেশে ‘শেক্সপিয়ার হলেন শেখ জুবায়ের’ বলে দাবি করেছেন এবং তার দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ ও দেননি। অতীতেও তিনি করোনা ভাইরাস সহ বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?