গল্পের ঘটনাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনের ঘটনা বলে প্রচার 

111
 গল্পের ঘটনাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনের ঘটনা বলে প্রচার 
 গল্পের ঘটনাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনের ঘটনা বলে প্রচার 

Published on: [post_published]

ফেসবুকে যা ছড়াচ্ছেঃ ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নামে মেকআপ না করার কারণ দাবিতে সম্প্রতি একটি গল্প ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে তাঁর মেকআপ না করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ঝারখন্ডের অভ্র খনিতে কাজ করতে গিয়ে তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদের (বাবা, মা, দুই ভাই ও বোন)মৃত্যু। যেহেতু অভ্র মেকআপের সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, তাই তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের পরিণতির কথা মনে করে মেকআপ করেন না।

আসল ঘটনাঃ দাবিটি মিথ্যা। ভাইরাল গল্পটি মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের লেখা “শাইনিং ফেসেস” নামক গল্পের অংশ। এর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর বাস্তব জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া, ভাইরাল গল্পে দ্রৌপদী মুর্মু সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্যেও অসঙ্গতি খুঁজে পায় ফ্যাক্টওয়াচ টিম। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল হওয়া পোস্টগুলোকে “মিথ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোষ্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানঃ 

দ্রৌপদী মুর্মু হলেন বর্তমানে ভারতের ১৫ তম রাষ্ট্রপতি। সম্প্রতি তাকে নিয়ে একটি গল্প ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সেখানে কলেজের শিক্ষার্থিদের সঙ্গে মালাপ্পুরম জেলাশাসক রানি সোয়ামোইয়ের কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘রানি সোয়ামোই’ দ্রৌপদী মুর্মুর জন্মগত নাম। দ্রৌপদী মুর্মুর নামে ছড়িয়ে পড়া গল্পের সাথে দ্রৌপদী মুর্মুর বাস্তব জীবনের কোনো সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভাইরাল পোস্টে দাবিগুলো হচ্ছে: 

  • দ্রৌপদী মুর্মু ঝাড়খণ্ডের একটি আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
  • জন্মের পরে তাঁর নাম রাখা হয় শ্রীমতী রানী সোয়ামই। সোয়ামই তাঁর পারিবারিক পদবী ।
  • দ্রৌপদী মুর্মু এবং তাঁর পরিবারের সবাই ঝারখন্ডের অভ্র খনিতে কাজ করতেন। তাঁর যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর পরিবারের সকললেই খনিতে কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন।
  • সরকারি অগাতি মন্দিরে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল।
  • তিনি একসময় কেরালার মলাপ্পুরম জেলার কালেক্টর ছিলেন।

বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড ধরে অনুসন্ধান করে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে এই তথ্যগুলোর বিপরীতে সঠিক তথ্য খুঁজে পায় ফ্যাক্টওয়াচ টিম। যার প্রেক্ষিতে আলোচিত তথ্যগুলো  অসঙ্গতিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। এই তথ্যগুলো কেন অসঙ্গতিপূর্ণ তাঁর ব্যাখ্যা নিম্নে দেয়া হলঃ

 ১. দ্রৌপদী মুর্মু ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের উপরবেদা গ্রামে একটি সাঁওতালি উপজাতি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঝাড়খণ্ডের কোনো আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেননি।

. ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম তাঁর জন্ম থেকেই “দ্রৌপদী” ছিল না। নামটি মহাকাব্য মহাভারতের একটি চরিত্রের উপর ভিত্তি করে তাঁর স্কুল শিক্ষক তাকে দিয়েছিলেন। তাঁর আসল সাঁওতালি নাম “পুটি” এবং পদবী ছিল “টুডু”। ১৯৮১ সালে শ্যাম চরণ মুর্মু নামে একজন ব্যাংক  অফিসারকে বিয়ে করার পর, তিনি তাঁর আগের উপাধি টুডুর পরিবর্তে মুর্মু উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন, যা তিনি স্কুল ও কলেজে ব্যবহার করতেন। রানী সোয়ামই কখনোই তাঁর নাম ছিলো না।

. দ্রৌপদী মুর্মুর  বাবার নাম বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু, যিনি পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। দ্রৌপদী মুর্মুর বাবা এবং দাদা দুজনেই পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার অধীনে সরপঞ্চ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু, ‘তাঁর পরিবারের সবাই ঝাড়খণ্ডের মাইকা খনিতে কাজ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন’ এই দাবির সমর্থনে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আজতাক বাংলার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দ্রৌপদী মুর্মু নামে ছড়িয়ে পড়া এই গল্পটি সম্পর্কে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেবেদন প্রকাশ করে। সেখানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভাইয়ের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে দ্রৌপদী মুর্মুর বাবা এবং মা বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

. দ্রৌপদী মুর্মু ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ জেলার উপারবেদা গ্রামের একটি  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তী শিক্ষার জন্য ভুবনেশ্বর চলে যান। তিনি ভুবনেশ্বরের রামাদেবী মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনিই তাঁর গ্রামের প্রথম নারী যিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

. ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত, মুর্মু ওড়িশা সরকারের সেচ বিভাগে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত, তিনি রায়রাংপুরের শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে সম্মানসূচক শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলেন। সেখানে তিনি হিন্দি, ওড়িয়া, গণিত এবং ভূগোল পড়াতেন। এরপর তিনি ওড়িশার বিধানসভার সদস্য হিসাবে রায়রাংপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং দুই মেয়াদে ২০০৯ পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তিতে ২০১৫ সালের ১৮ মে তিনি ঝাড়খণ্ডের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন৷ ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। অর্থাৎ, কেবল কেরালার মলাপুরম জেলাই নয় বরং অন্য কোনো জেলারও কালেক্টর পদের দায়িত্বে তিনি কখনও ছিলেননা। পরবর্তিতে মালাপ্পুরম জেলার জেলাশাসকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে  ১৯৬৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মোট ৬৭ জন কালেক্টরের তালিকা পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানে রানী সোয়াময়ী নামের কোনো কালেক্টরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, দ্রৌপদী মুর্মুর মেকআপ না-করা নিয়ে গল্পটি কমপক্ষে ২০২২ সাল থেকে বিভিন্ন ভাষায় ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে মালায়ালাম একজন লেখক হেকিম মোরায়ুর ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ফেসবুকে মালায়ালাম ভাষায় একটি পোষ্ট করেন। তিনি একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন যে ভাইরাল গল্পটি তাঁর কাল্পনিক ছোটগল্পের সংকলন “থ্রি উইমেন” থেকে নেওয়া হয়েছে। রানী সোয়ামোই হচ্ছে তাঁর লেখা “থ্রি উইমেন(മൂന്നു പെണ്ണുങ്ങൾ)” গল্প সমগ্রের “শাইনিং ফেসেস” নামক গল্পের একটি কাল্পনিক চরিত্র। তিনি তাঁর দাবি প্রমাণ করার জন্য তাঁর বই থেকে গল্পের ছবিও শেয়ার করেছেন।

যেহেতু ভাইরাল গল্পটির সাথে দ্রৌপদী মুর্মুর বাস্তব জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি, সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ আলোচিত ফেসবুক পোষ্টগুলোকে মিথ্যা হিসেবে সাব্যস্ত করেছে।

এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।।
এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।

কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকেঃ
ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

No Factcheck schema data available.