সম্প্রতি ” চুয়াডাঙ্গায় শিশুর কামড়ে গোখরা সাপের মৃত্যু” শিরোনামে একটি সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মৃত সাপটি গোখরা নয় বরং কমন ওল্ফ বা ঘরগিন্নি সাপ। উল্লেখ্য গোখরা সাপ যতটা বিষধর বিপরীতে ঘরগিন্নি ততটা নির্বিষ। এই ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে প্রচার হতে থাকে। তবে নির্বিষ ঘরগিন্নি সাপের বদলে তাদের অধিকাংশই বিষধর গোখরা সাপের কথা উল্লেখ করেন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশ ও সাপ রক্ষাকারী সংগঠন “ডিপ ইকোলজি এন্ড স্নেক রেসকিউ” অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট মাহফুজুর রহমান একটি লিখিত প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করেছেন। নিহত সাপটি সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার করার কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এসকল সংবাদগুলোকে “আংশিক মিথ্যা” চিহ্নিত করেছে।
অবশ্য বেশকিছু সংবাদমাধ্যম পরবর্তীতে তাদের সংবাদ সংশোধন করেছে।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটির ভিডিও ফুটেজ থেকে স্থিরচিত্র নিয়ে গুগলে একাধিকবার মিলিয়ে দেখা যায় ছবি ও ভিডিও ফুটেজে ব্যবহৃত সাপটি Common Wolf বা ঘরগিন্নি। বিষয়টি নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী ও সাপ উদ্ধারকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলেন, গণমাধ্যমে যেসকল ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছেন সেখানে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় সাপটি গোখরা নয় বরং নিরীহ নির্বিষ ঘরগিন্নি। প্রথম সারির এসকল গণমাধ্যমে এমন বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশনের কারণে তারা বেশ উদ্বিগ্ন। সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদলিপিও প্রকাশ করেছেন তারা। প্রতিবাদলিপিটি দেখুন এখানে।
ঘটনাটি নিয়ে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পরিবেশবিদ বখতিয়ার হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, মারা যাওয়া সাপটির নাম ‘ঘরগিন্নি’ (কমন উলফ স্নেক)। এটি সম্পূর্ণ বিষহীন সাপ। সাপটি সদ্য ভূমিষ্ট হওয়ায় অল্প আঘাতেই মারা গেছে। তিনি বলেন, একটি পূর্ণবয়স্ক সাপ সর্বোচ্চ দেড় ফুট লম্বা হয়। সাধারণত টিকটিকি খাওয়ার জন্য এই সাপ ঘরে ঢোকে”। বিভিন্ন গণমাধ্যম যেখানে বিষধর গোখরা সাপ বলে সংবাদ পরিবেশন করেছে সেখানে প্রথম আলো, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পরিবেশবিদ বখতিয়ার হামিদের বরাতে জানাচ্ছে সাপটি ‘ঘরগিন্নি’ (কমন উলফ)। অতএব, পরিবেশবিদ, সাপ উদ্ধারকারী সংস্থা প্রতিনিধি ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা নিশ্চিত করছে সাপটি ‘ঘরগিন্নি’ (কমন উলফ) বিষধর গোখরা নয়।
বিষাক্ত, বিষধর ও নির্বিষ সাপ পরিচিত দেখে নেয়া যাক:
যেসকল সাপের বিষগ্রন্থি বা বিষদাঁত থাকে, তা দিয়ে তারা কামড়ের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ বা বিষ ঢেলে দেয়। বিষক্রিয়ার কারণে ভিকটিমের শরীরে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়, নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা না পেলে ভিকটিমের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান কিছু বিষধর সাপের ছবি দেখে নেয়া যাক।
চন্দ্রবোড়া (Russell viper)
গোখরা (Cobra)
শঙখিনী (Banded krait)
কালাচ (Common krait)
বিষাক্ত সাপ: প্রকৃতিতে কিছু সাপ আছে যেগুলোর শরীরই বিষাক্ত। এই সাপগুলোর সংস্পর্শে যাওয়া মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। লালগলা ধোড়া সাপ তাদের মধ্যে অন্যতম।
নির্বিষ সাপ: প্রকৃতিতে বিরাজমান এই সাপগুলো মানুষের জীবননাশের ক্ষমতা রাখে না। দাঁড়াশ, দুধরাজ, কালনাগিনী, বেত আছড়া, ঘরগিন্নি, হেলে সাপ, দুমুখো সাপ, জলঢোঁড়া ইত্যাদি।
বিষয়টি নিয়ে ফ্যাক্টওয়াচেরঅনুসন্ধানের কারণ: জুলাই ১৩, ২০১৭ তারিখে প্রথম আলো থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে বছরে ৬ হাজারের বেশি মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়”। মৃতদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই প্রত্যন্ত অঞ্চলের। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন ও ডাক্তারের বিবৃতি অনুযায়ী সাপে কাটা রোগীদের অধিকাংশই সাপ বিষয়ে খুবই উদাসীন বা অজ্ঞ হয়ে থাকেন। এমন কি বিষধর সাপে কামড়ালেও তারা শুরুতে কবিরাজি চিকিৎসার শরণাপন্ন হন৷ পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি ঘটলে তারা চিকিৎসকের কাছে যান। দেখা যায় ততক্ষণে রোগীর অবস্থা শেষ পর্যায়ে চলে যায়। সাপ বিষয়ে মানুষের উচ্চ ভীতিও বেশ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, নির্বিষ কোনো সাপের কামড়েও মানুষের ভয়, উৎকণ্ঠায় হৃদক্রিয়া অচল হয়ে যায় ফলাফল মৃত্যু ডেকে আনে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে বিষধর, বিষাক্ত সাপের ২৬টি প্রজাতি রয়েছে এদের মধ্যে ১২ প্রজাতিই সামুদ্রিক। মানুষের আশেপাশে থাকা অধিকাংশ সাপই নির্বিষ এবং পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী। সাপ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা থাকায় মানুষ নির্বিচারে সাপ হত্যা করে থাকে। এটি পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রাণী গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ পরিচিত ও সাপ সচেতনতা মানুষের মাঝে সাপ ভীতি সম্পূর্ণরূপে দূর করতে পারে। এছাড়াও সাপে কামড়ালে নিদিষ্ট সময়ে সঠিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করলে জীবন বেঁচে যাবার শতভাগ সুযোগ থাকে। সাপ সচেতনতায় গণমাধ্যমে যেখানে অভূতপূর্ব ভুমিকা রাখতে পারে ঠিক সেই স্থানে সাপ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন একটি দেশের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য অশুভবার্তা বয়ে নিয়ে আসে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?