রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ভাস্কর্যের ছিন্ন মস্তকের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সরাসরি,কিংবা ইঙ্গিতে দাবি করা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ভাস্কর্যটা ভাংচুর করে ফেলে রাখা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে,২০২৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এই ছিন্ন-মস্তক পাওয়া গিয়েছিল। ভাংচুরের জন্য সরাসরি দায়ী কাউকে সনাক্ত করা যায় নি। যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারের পদত্যাগের পরে এই ঘটনা ঘটেনি, তাই এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ ‘বিভ্রান্তিকর’ সাব্যস্ত করছে।
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে দেখা গেল, ছিন্ন মস্তকের এই ছবিটি ২০২৩ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এমন কয়েকটি খবর দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে । খবরে জানা যাচ্ছে, সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি সংলগ্ন ফটক ও ছবির হাটের মাঝামাঝি স্থানে ভাস্কর্যটির খণ্ডিত অংশ পড়ে থাকতে দেখেন পথচারীরা।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। এই বিশেষ ভাস্কর্যের অংশবিশেষ উদ্ধারের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে, ছাপা হয় পত্রিকার পাতায়।
রবীন্দ্রনাথের এই ভাস্কর্যটা টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাশে এবং একুশে বইমেলার প্রবেশপথ থেকে অনতিদূরে স্থাপন করা হয়েছিল ২০২৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। ভাস্কর্যটিতে কবিগুরুকে উপস্থাপন করা হয়েছে ভিন্ন রূপে; তার মুখ টেপ দিয়ে বাঁধা, হাতে থাকা কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলিতে ঠুকে ছিল বড় পেরেক।
এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে সেই বছর বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টল বরাদ্দ না দেওয়া, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হয়রানিসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতার অভাবকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে ভাস্কর্য নির্মাণের সাথে জড়িত শিমুল কুম্ভকার বলেছিলেন, “বাঙালি মাত্রই স্বীকার করবেন রবীন্দ্রনাথ মুক্তচিন্তা শিল্পসাহিত্য এবং সৃজনশীলতার প্রতীক। এখন মুক্তচিন্তা, নতুন লেখা রাষ্ট্র কর্তৃক হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। আমরা দেখিয়েছি তিনি হাতের বইটা খুলতে পারছেন না, মুখে টেপ লাগানো। এর মাধ্যমে মুক্তচিন্তা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেটিই বোঝাতে চেয়েছি।”
বাঁশ,থার্মোকল ও কাগজ দিয়ে তৈরি সাড়ে ১৯ ফুট দীর্ঘ এই ভাস্কর্যটি পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে সেখানে প্রদর্শনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দুই দিন পরেই ১৬ই ফেব্রুয়ারি সকালে সেখানে আর ভাস্কর্যটি দেখা যায়নি। গভীর রাতে অজ্ঞাতনামা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উক্ত ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলেছিল। ভাস্কর্য নির্মানের সাথে জড়িত শিল্পীরা এই ভাস্কর্য ‘গুম’ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিমকে দায়ী করেছিলেন। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাস্কর্য স্থাপনের এই স্থানটি এবং আশেপাশের এলাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী সে সময়ে দৈনিক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘একটা ভাস্কর্যের পাশে আরেকটা ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কারা এ কাজটি করল, সেটা আমরা জানার চেষ্টা করছি। যে চিন্তা থেকেই ভাস্কর্যটি বসানো হয়ে থাকুক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আগে জানানো উচিত ছিল। ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য স্থাপনের ক্ষেত্রে কিছু নিয়মনীতি আছে। যে-ই সেটি সরিয়ে থাকুক না কেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কেউ এসে একটি ভাস্কর্য বসিয়ে যাবে, সেটা তো প্রত্যাশিত নয়।’
এর এক দিন পরে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ভাস্কর্যের খণ্ডিত অংশ টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের অনতিদূরেই পাওয়া যায়।
সিদ্ধান্ত
যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাস্কর্য ভাঙা বা সেটি উদ্ধারের ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় — কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটেই এই ছবিটি শেয়ার করা হচ্ছে, তাই ফ্যাক্টওয়াচ সাম্প্রতিক এ সকল পোস্টকে ‘বিভ্রান্তিকর’ হিসেবে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।