সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে চলমান দাবদাহের প্রেক্ষিতে ফেসবুকে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। লাল ছাদওয়ালা একটি সাদা বাড়ির ছবি শেয়ার করে ফেসবুকে বলা হচ্ছে, আমেরিকায় দাবানলে সব কিছু পুড়ে গেলেও এই বাড়িটি পোড়েনি কারণ এই বাড়ির মালিক মুসলমান এবং বাড়ির ভিতরে একটি কোরআন ছিল। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, বাড়িটির মালিক হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের জনৈক ট্রিপ মিলিকেন (Trip Milliken)। তার ধর্ম পরিচয়ে কোথাও মুসলমান পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া বাড়ির ভিতরে কোরআন ছিলো বলেও নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র থেকে জানা যায়নি। ২০২৩ সালের আগস্টে হাওয়াই রাজ্যের মাউই (Maui) কাউন্টিতে এক ভয়াবহ দাবানল হানা দিয়েছিল। সেই সময় এই বাড়িটি বেঁচে যায়, কারণ বাড়িটির ছাদ ধাতব উপাদানে তৈরি এবং অন্যান্য বাড়ি থেকে এটি কিছুটা দূরে অবস্থিত ছিলো।
২০২৩ সালের আগস্টে হাওয়াই রাজ্যের দাবদাহের পরে লাল ছাদের এই বাড়িটির অক্ষত থাকা নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। সে সময় বিখ্যাত সব সংবাদ সংস্থা এই বাড়িটি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দাবদাহের ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাড়িটি দেখতে যান। বাড়িটির গঠনের বিশেষত্ব নিয়ে প্রতিবেদনগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বলা হয়, বাড়িটির ছাদ ধাতব উপাদানে তৈরি, অন্যান্য বাড়ি থেকে এর দূরত্ব এবং পুরো বাড়িটির কাঠের কাঠামো কোনো বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরিসহ এমন নানা কারণে এটি আগুণ থেকে বেঁচে গেছে। একশো বছরের পুরোনো বাড়িটিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম মিরাকল হাউজ বলে অভিহিত করে সেসময়। বিশেষজ্ঞরা বাড়িটির আলৌকিক টিকে থাকার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। মিলিকেন পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রায় ১০০ বছরের পুরানো বাড়ি যে কীভাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বিরুদ্ধে টিকে রইল, তা বোঝানো কঠিন। ট্রিপ মিলিকেন দুটি প্রধান কারণের দিকে ইঙ্গিত করেন, একটি হল সৌভাগ্য, আরেকটি হলো ঘর সংস্কারের সময় ধাতব ছাদ লাগানো। ট্রিপ আরও বলেন, বিশেষ আস্তর দেওয়া ধাতব ছাদ, বাড়ির চারপাশে পাথরের এলাকা এবং বাড়ির চারপাশের তালগাছগুলির তাপ শোষণ বাড়িটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাড়িটি ১৯২৫ সালে বানানো, ট্রিপ ও ডোরা এটি কিনেছিলেন ২০২১ সালে। ২০২২ সালে তারা এটির মেরামতের কাজ শেষ করেন। ট্রিপ জানান, আমরা ছাদের উপর পাঁচটি আসফাল্টের স্তর অপসারণ করেছি, নতুন ধাতব ছাদ তৈরি করেছি। তিনি জানান, এতে একটি বায়ু স্তর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যা তাপ নির্গত হতে সাহায্য করে। মাটির স্তরে, তারা বাড়ির ড্রিপলাইন বরাবর সমস্ত উদ্ভিদ সরিয়ে ফেলেন এবং একটি পাথরের বাফার যোগ করেন — যা অগ্নিকাণ্ডের জন্য নয়, বরং পিঁপড়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বাড়িটির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছিলেন। বাড়ির ধাতব ছাদ, যা অ্যাসফাল্টের পরিবর্তে স্থাপন করা হয়েছিল, এটিই সম্ভবত পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চল থেকে আগুনের সংস্পর্শ ঠেকাতে সাহায্য করেছে। বাড়িটির কাঠের গঠন, যা পুরোপুরি কাঠের হলেও, তার স্থিতিশীলতা এটির সহনশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। এর অবস্থান এবং বিশেষ ধরণের গঠনও আগুনের বিস্তার রোধে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।
এদিকে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়ার আগুনে পুড়ে গেছে প্রায় এক ডজন ধর্মীয় উপাসনালয়। পুড়ে গেছে ঐতিহাসিক আফ্রিকান- আমেরিকান মসজিদ, আল-তাকওয়া। আল-তাকওয়া মসজিদের কাছে আলটাডিনা ব্যাপটিস্ট চার্চের সব পুড়ে গেছে। এই চার্চটি ১৯২০ এর দশকে একটি সুইডিশ সম্প্রদায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে একটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। চার্চের ১৫টি পরিবারের সদস্যরাও আগুনে তাদের বাড়ি হারিয়েছেন ; জানিয়েছেন ৮৮ বছর বয়স্ক রেভ. জর্জ ভ্যান আলস্টাইন, যিনি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চার্চের কর্মী। ভ্যান আলস্টাইন বলেন, চার্চের ইতিহাসের একটি ভল্ট সম্ভবত আগুনে হারিয়ে গেছে, যার মধ্যে চার্চের শুরুর দিনগুলির রেকর্ডও ছিল। লস এঞ্জেলেস টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, পাসাডেনা জুডিশ টেম্পল, করপাস ক্রিস্টি ক্যাথলিক চার্চ এবং অন্তত ১০টি প্রটেস্ট্যান্ট চার্চও পুড়ে গেছে। এসব চার্চে লুটপাটও হয়।
২৪ আগস্ট, ২০২৩ এর ইন্ডেপেন্ডেন্ট (Independent) এর প্রতিবেদনে বলা হয়, লাল ছাদের ঐ বিস্ময়-বাড়িটির মালিক ট্রিপ মিলিকেন এবং তাঁর স্ত্রী ডোরা আটওয়াটার মিলিকেন। সে সময় তারা তাদের বাড়িটি নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন।
সুতরাং, বিষয়টি পরিষ্কার যে ঘটনাটি সাম্প্রতিক নয় বরং ২০২৩ সালের। এই ঘরের মালিক মুসলিম কিংবা ঘরের ভিতরে কোরআন ছিলো এমন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং, বাড়ির মালিকের ভাষ্য এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে জানা যায় যে, বাড়িটির অবস্থান এবং বাড়িতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের কারণে এটি আগুন থেকে বেঁচে গিয়েছিলো। ফলে সঙ্গত কারণে, বাড়িটির আগুনে পোড়া থেকে বেঁচে যাওয়া নিয়ে অলৌকিক গল্পগুলোকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে ফ্যাক্টওয়াচ।
Claim: লাল ছাদওয়ালা একটি সাদা বাড়ির ছবি শেয়ার করে ফেসবুকে বলা হচ্ছে, আমেরিকায় দাবানলে সব কিছু পুড়ে গেলেও এই বাড়িটি পোড়েনি কারণ এই বাড়ির মালিক মুসলমান এবং বাড়ির ভিতরে একটি কোরআন ছিল।
Claimed By: facebook users
Rating: False
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের
নীতি মেনে লেখা হয়েছে। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে।
এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।
কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh