গত ১২ অক্টোবর ২০২৩ এ “Voice of Bangladesh” নামক ফেসবুক পেইজ থেকে ফিলিস্তিন নয় যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে ইসরাইলকে সাপোর্ট করছে বিএনপি – শীর্ষক দাবি সংবলিত তারেক রহমানের একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিলো। তবে ফ্যাক্টওয়াচ উক্ত ভিডিওটি যাচাই করে বেশকিছু অসঙ্গতি খুঁজে পেয়েছে, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে ভিডিওটি ডিপফেক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। তারেক রহমানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে প্রাপ্ত অন্য একটি ভিডিওর সাথে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি তুলনা করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিকে “বিকৃত” বলে সাব্যস্ত করছে।
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি যথাযথ কি না তা যাচাই করতে আমরা কিছু প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করে অনুসন্ধান চালিয়েছি। আমাদের অনুসন্ধানে এ জাতীয় কোনো ভিডিও তারেক রহমানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ কিংবা বিএনপির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ১২ অক্টোবর, ২০২৩ বা তার আশেপাশের তারিখে দেখা যায় নি। পুনরায় অনুসন্ধানে তারেক রহমানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে গত ২৫ জুলাই ২০২৩ এ প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া গেছে, যার সাথে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির বেশ মিল রয়েছে। সেই ভিডিওতে তিনি গত ২৭ জুলাই ২০২৩ আয়োজিত ঢাকার মহাসমাবেশকে সফল করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ভিডিও দুটি এক হলেও বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাছাড়া, তারেক রহমানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে প্রাপ্ত ভিডিওর বিপরীতে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে বেশকিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে, যা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি ভিডিওটি ডিপফেক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। যেমন-
এক. চোখের পাতার অস্বাভাবিক নড়াচড়া
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির প্লেব্যাক স্পিড কমিয়ে দেখা গেছে তারেক রহমানের চোখের পাতা পুরোপুরি পড়ছে না, যেখানে তারেক রহমানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে তাঁকে পুরোপুরি চোখের পাতা ফেলতে দেখা গেছে। এই অসঙ্গতি দেখে বুঝা যাচ্ছে এটা একটি ডিপফেক ভিডিও। এমআইটি মিডিয়া ল্যাব ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের একটি উপায় হিসেবে চোখের পাতার অস্বাভাবিক নড়াচড়া খেয়াল করতে উপদেশ দিয়েছে।
দুই. ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে তারেক রহমান যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁর ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে ভিডিওর শেষ দিকে তিনি যখন “সবাইকে ধন্যবাদ” কথাটা বলছিলেন, তখন তাঁর ঠোঁটের নড়াচড়ার সাথে বক্তব্যের পার্থক্যটি পরিষ্কার বোঝা যায়। ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া ডিপফেক ভিডিও শনাক্তকরণের আরেকটি উপায়।
তিন. অপরিবর্তিত কন্ঠনালী (Adam’s Apple)
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে তারেক রহমান যখন “প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম” কথাটা বলছিলেন তখন তাঁর কন্ঠনালীর (Adam’s Apple) কোন উঠানামা বা পরিবর্তন হয় নি। এমনকি পুরো ভিডিওতে তারেক রহমানের কন্ঠনালীতে কোন পরিবর্তন দেখা যায় নি। অন্যদিকে, তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত ভিডিওতে যখন তাঁকে কথা বলতে শোনা যায়, তখন তাঁর কন্ঠনালীতে উঠানামা লক্ষ্য করা গেছে। কথা বলার সময় কন্ঠনালীর উঠানামা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ভিডিওতে দৃশ্যমান ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ডিপফেক ভিডিওর একটি লক্ষণ।
চার. ভিডিওর সাবজেক্ট ক্রমাগত ডান থেকে বামে নড়ছে
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে তারেক রহমান যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁকে ক্রমাগত ডান দিক থেকে বাম দিকে নড়তে দেখা গেছে, যা অনেকটাই যান্ত্রিক এবং মানুষের স্বাভাবিক নড়াচড়ার মত নয়। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে প্রাপ্ত আসল ভিডিওটিতে এমন নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায় নি। ভিডিওর সাবজেক্টের এই ক্রমাগত দিকপরিবর্তন আমাদেরকে ডিপফেকের দিকে নির্দেশ করছে।
পরবর্তীতে, প্রাপ্ত ভিডিওকে ইন্টারনেটে পাওয়া একটি ডিপফেক ডিটেক্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হলে জানা যায়, এর অডিও অংশটির ৯৮.৮১ শতাংশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, ডিপফেক (Deepfake) হচ্ছে এক ধরণের সিন্থেটিক মিডিয়া, যা ডিপ লার্নিং এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মুখাবয়ব বা কন্ঠ নিবিড়ভাবে অনুকরণ করে অন্য আরেকজন ব্যক্তিতে তার প্রতিস্থাপন করতে পারে। সিন্থেটিক মিডিয়া বলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে তৈরি কৃত্রিম টেক্সট, ইমেজ, ভিডিও, সাউন্ডকে বুঝানো হয়। অন্যদিকে, নন-সিন্থেটিক মিডিয়া বলতে বাস্তব পরিবেশ এবং মানুষের সাহায্য নিয়ে তৈরি যেকোন মিডিয়াকে বুঝানো হয়। ডিপফেক, সিন্থেটিক মিডিয়া, মেশিন লার্নিং নিয়ে বিস্তারিত জানতে ফ্যাক্টওয়াচ এর “ডিপফেক ভিডিও বুঝবেন কি করে?” শিরোনামের ফ্যাক্ট-ফাইলটি পড়ুন এখানে।
অতএব, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওতে প্রাপ্ত অসঙ্গতিগুলো বিবেচনায় এনে বোঝা যাচ্ছে উক্ত ভিডিওটি ডিপফেক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতে বিএনপি ইসরায়েলকে সাপোর্ট করছে – এই মর্মে কোন ভিডিও বার্তা তারেক রহমান, বিএনপি কিংবা কোন গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিকে “বিকৃত” বলে সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।