সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের একটি ভিডিও শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে, যেখানে তিনি বলছেন – “আমার আম্মা শেখ হাসিনা একটা মিথ্যুক। সে নিজেই ভোট কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করে। আবার বিএনপি ভোট বর্জন করলে অসাংবিধানিক বলে আটক করতে বলে। কি যে বিপদে আছি। যাই-ই হোক, আমার ভুল হয়েছে, ক্ষমা করে দেন। সাত তারিখ সারাদিন হরতাল পালন করুন। সাত তারিখ কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। ঘর থেকে বের হবেন না। জয় বাংলা।” তবে উক্ত ভিডিওটি যাচাই করে দেখা গেছে, সেটা একটি ডিপফেক। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের একটি স্থিরচিত্রকে – যার সাথে আলোচিত ভিডিওটির মিল রয়েছে – এমনভাবে চালানো হয়েছে, যা দেখে মনে হচ্ছে ডিবি প্রধান আসলেই কথাগুলো বলছেন! তাই সঙ্গত কারণে ফ্যাক্টওয়াচ সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিকে “বিকৃত” বলে সাব্যস্ত করছে।
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি যথাযথ কিনা তা যাচাই করতে আমরা উক্ত ভিডিও থেকে একটি স্ক্রিনশট নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করি। আমাদের অনুসন্ধানে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি ছবি খুঁজে পাওয়া গেছে, যার সাথে আলোচিত ভিডিওটির বেশ মিল রয়েছে। পরে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বেশকিছু অস্বাভাবিকতা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যা সাধারণত কোন মানুষের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার সময় ঘটে না। আলোচিত ভিডিওটিতে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, কথা বলার সময় মুখমণ্ডল ছাড়া দেহের বাকি অংশের অস্বাভাবিক দৃঢ়তা – ইত্যাদি আলামত থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে, ভিডিওটি একটি ডিপফেক। মূলত ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে প্রাপ্ত স্থিরচিত্রটিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় এমনভাবে জীবন্ত ব্যক্তির মুখাবয়ব এবং কন্ঠ অনুকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা দেখে মনে হচ্ছে বাস্তবের ডিবি প্রধানই কথাগুলো বলছেন! আলোচিত ভিডিওটির অস্বাভাবিকতাগুলো পাঠকদের সুবিধার্থে নিচে আলোচনা করা হলো –
ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া:
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটির প্লেব্যাক স্পিড কমিয়ে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের ঠোঁটের সাথে তাঁর বলা প্রত্যেকটি বাক্যের সিনক্রোনাইজেশন বা সমলয় বিধান ঠিকমতো হচ্ছে না। অর্থাৎ, ভিডিওটিতে ডিবি হারুন যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁর প্রত্যেকটি বাক্য বলা শেষ হওয়ার আগেই ঠোঁট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এমআইটি মিডিয়া ল্যাব ডিপফেক শনাক্তকরণের একটি উপায় হিসেবে ঠোঁটের নড়াচড়ার দিকে খেয়াল রাখতে উপদেশ দিয়েছিল। কেননা কিছু ডিপফেক ঠোঁটের সাথে বাক্যের সিনক্রোনাইজেশনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয় এবং সিনক্রোনাইজ ভালোভাবে না হলে সেখানে কিছু অস্বাভাবিকতা স্বাভাবিকভাবেই চোখে পড়ে। তাই ঠোঁটের অস্বাভাবিক নড়াচড়া ডিপফেক শনাক্তকরণের একটি ভালো কৌশল।
দেহের অস্বাভাবিক দৃঢ়তা (Stiffness):
সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটিতে লক্ষ্য করা গেছে ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদ যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁর মুখমন্ডল ব্যতীত দেহের বাকি অংশ অস্বাভাবিক রকমের দৃঢ় ছিল। যখন কোন মানুষ কথা বলেন তখন তার পুরো শরীর স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দিকে নড়াচড়া করে। শুধু মাথা নাড়িয়ে দেহের বাকি অংশ অনমনীয় রেখে কথা বলাটা একটু অস্বাভাবিকই ঠেকে! তবে ডিপফেক শনাক্তকরণের আরেকটি উপায় যখন দেহের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, তখন আলোচিত ভিডিওটিতে ডিবি হারুনের দেহের অস্বাভাবিক দৃঢ়তা এটাই ইঙ্গিত করে যে ভিডিওটি একটি ডিপফেক। কোন ভিডিওতে ব্যক্তির মাথা এবং দেহের সাযুজ্য যখন রক্ষা হয় না, তখন সেটাও ডিপফেকের একটি লক্ষণ।
এর আগে তারেক রহমানের একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হয়েছিল, যা ফ্যাক্টওয়াচ সেই সময় যাচাই করে দেখেছিল এবং সেটাকে ডিপফেক বলে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফ্যাক্টওয়াচের প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে, ভিডিওটি দেখুন এখানে।
উল্লেখ্য, ডিপফেক (Deepfake) হচ্ছে এক ধরণের সিন্থেটিক মিডিয়া, যা ডিপ লার্নিং এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মুখাবয়ব বা কন্ঠ নিবিড়ভাবে অনুকরণ করে অন্য আরেকজন ব্যক্তিতে তার প্রতিস্থাপন করতে পারে। সিন্থেটিক মিডিয়া বলতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে তৈরি কৃত্রিম টেক্সট, ইমেজ, ভিডিও, সাউন্ডকে বুঝানো হয়। অন্যদিকে, নন-সিন্থেটিক মিডিয়া বলতে বাস্তব পরিবেশ এবং মানুষের সাহায্য নিয়ে তৈরি যেকোন মিডিয়াকে বুঝানো হয়। ডিপফেক, সিন্থেটিক মিডিয়া, মেশিন লার্নিং নিয়ে বিস্তারিত জানতে ফ্যাক্টওয়াচ এর “ডিপফেক ভিডিও বুঝবেন কি করে?” শিরোনামের ফ্যাক্ট-ফাইলটি পড়ুন এখানে।
অতএব, সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদের ভিডিওটিতে দৃশ্যমান অস্বাভাবিকতাগুলো বিবেচনায় এনে বোঝা যাচ্ছে উক্ত ভিডিওটি একটি ডিপফেক। তাছাড়া, ডিবি প্রধান নির্বাচন বর্জন করে ঘরে বসে থাকতে বলেছেন – এমন কোন কথা কোথাও পাওয়া যায় নি।
সুতরাং, সবকিছু বিবেচনা করে ফ্যাক্টওয়াচ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ারকৃত ভিডিওটি বিকৃত।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।