সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে দাবি করা হচ্ছে, গরুর মাংস বিক্রি করার আগে ব্যবসায়ীরা সিরিঞ্জ দিয়ে মাংসে তরল জাতীয় কিছু পুশ করছে। যার ফলে মাংসে ওজন বৃদ্ধি পাবে। মানব স্বাস্থ্যের জন্যও এটি মারাত্বক ক্ষতিকর। আসলে কি খাচ্ছি আমরা? দাবিগুলো এমনভাবে করা হয়েছে, যা দেখে সাধারণ ব্যবহারকারীরা ভেবেছেন এটি বাংলাদেশের কোনো ঘটনা। যদিও ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এটি বাংলাদেশের কোনো ঘটনা নয়। ভিডিওটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, ভিডিওটিতে দেখতে পাওয়া ব্যক্তির টি-শার্টের লেখা পড়ে ও রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে জানা গেছে, লাতিন আমেরিকার কোনো দেশে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। তাই বিদেশের ভিডিও বাংলাদেশে যেভাবে ছড়ানো হয়েছে, তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ এ পোস্টকে “বিভ্রান্তিকর” চিহ্নিত করছে।
গুজবের উৎস
১৫ মার্চ “সত্যানুসন্ধ্যানে প্রকৌঃ আ.কা.আজাদ” ফেসবুকে একাউন্ট থেকে “কি খাচ্ছেন আসলে গরুর মাংশের নামে? দেখুন ব্যবসায়ীদের কারবার! ওরা মনে করে ওরা কখনোই মরবেনা” এমন ক্যাপশনে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। এরপরে তা দ্রুত ভাইরাল হতে থাকে। যদিও তারও এক আগে মো জিয়ারুল ইসলাম নামক ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গরুর মাংসের মান ও দাম বৃদ্ধি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বেশ আলোচনা চলছে। এমন সময়ে উক্ত ক্যাপশনে ছড়ানো ভিডিও যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। ভিডিওটির বিষয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের মন্তব্য দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান:
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি সিরিঞ্জ দিয়ে মাংসে কিছু একটা মেশাচ্ছেন। তাকে সাহায্য করছেন আরও দুজন ব্যক্তি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভিডিওটি একাধিকবার দেখা হলেও সেখানে কোনো কথা শোনা যায়নি। যে কারণে তারা কোনো ভাষাভাষী তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে এই কাজের সাথে যে তিনজন ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে, তাদেরকে দেখে বাংলাদেশী বলে মনে হয়নি। যদিও ভাইরাল ভিডিওতে এমনকিছুও দেখা যায়নি যা দেখে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিদের পরিচয় জানা যাবে। তথ্য সূত্রের সুনিদিষ্ট উৎস পেতে ভিডিওতে থাকা ব্যক্তি অর্থাৎ যিনি মাংসে ইঞ্জেকশন পুশ করছেন তার টি-শার্টের লেখা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে পাওয়া উনিয়ন লাতিনোআমেরিকানা আসাদোরেস ই আফিনেস (Unión Latinoamericana Asadores Y Afines) লেখা পাওয়া যায়। যার ইংরেজি অনুবাদ করা হলে দাঁড়ায় লাতিন আমেরিকান ইউনিয়ন অফ স্টেকহাউজেস অ্যান্ড রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রিজ (Latin American Union of Steakhouses and Related Industries)। সুতরাং এ থেকে প্রাথমিক একটি সূত্র পাওয়া গেলো যে ঘটনাটি লাতিন আমেরিকার কোনো অঞ্চলে হতে পারে।
আরও বেশি তথ্য জানতে ভাইরাল ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে একটি ভিডিও পাওয়া যায়। যে ভিডিওর সাথে ভাইরাল ভিডিওটির হুবহু মিল রয়েছে। ভিডিওটির ক্যাপশন এবং কমেন্ট বক্সে হওয়া আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার যে এটিই মূল ভিডিও যা বাংলাদেশে ভাইরাল হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এল তাপেক কনদিমেনতোস (El Tapeque Condimentos)নামের একটি টিকটক অ্যাকাউন্টে থেকে ২৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। ভিডিওটির কমেন্ট বক্সে যেয়ে দেখা যায়, মাংসে ইঞ্জেকশন দিয়ে কিছু ঢোকানোর দৃশ্য দেখে কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মন্তব্যকারীদের একজনকে জবাব হিসেবে কনদিমেনতোস একাউন্ট থেকে জানানো হয়েছে, পানি এবং লবণ মেশানো হচ্ছে। মাংস পুরোটাই রোস্ট করা হবে। কিন্তু কিছু অংশ আছে যেমন পেছনের হাড়। ঠিকমতো রান্নার জন্য এর ভেতরে ১৬ ঘন্টা লবণ থাকার দরকার আছে। (ইংরেজি থেকে অনুবাদিত)।
এল তাপেক কনদিমেনতোস একাউন্ট থেকে উক্ত ভিডিওর ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, টেইয়ার মায়েস্ত্রো পারিয়েরো কারলোস (TALLER MAESTRO PARRILLERO CARLOS, এটির ইংরেজি অনুবাদ করে পাওয়া গেছে, Master Grill Workshop Carlos.
বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড ধরে সার্চ করে এল তাপেক কনদিমেনতোস এরটিকটক অ্যাকাউন্ট এর পাশাপাশি একই নামে একটিফেসবুক পেইজ ও পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, তিনি সাধারণত বার্বিকিউ মসলা বিক্রি প্রতিষ্ঠানের জন্য পোস্ট করে থাকেন। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ার সান্টা ক্রুজ দে লা সিয়েরা নামক শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি।
সুতরাং একাধিক তথ্য-উপাত্তের আলোকে জানা যাচ্ছে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নয়। তাই সার্বিক বিবেচনায় ফ্যাক্টওয়াচ দাবিগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” সাব্যস্ত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।