‘টাইটানিকের পাশেই পাওয়া গেল টাইটানের ধ্বংসাবশেষ’ মর্মে একটি পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে সম্প্রতি দুর্ঘটনার কবলে পড়া সাবমার্সিবল ‘টাইটান’ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এবং একটি পানির তলে একটি জলযানের ধ্বংসাবশেষের ছবি রয়েছে। এখান থেকে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ধারনা করতে পারেন যে ছবিগুলো ‘টাইটান’ এর ধ্বংসাবশেষের। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছবিগুলো ২০০৪ সালে কামেরাবন্দী করা টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের ছবি।
২১ জুন, ২০২৩ তারিখে CNN সংবাদমাধ্যম থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে ১৮ই জুন, ২০২৩ তারিখ সকালে ওশানগেট এক্সপেডিশন (OceanGate Expeditions) নামক সমুদ্রভ্রমণ প্রতিষ্ঠানের টাইটান নামক সাবমেরিন বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পরিদর্শনে বের হয়। টাইটান সাবমেরিনে পাঁচজন যাত্রী ছিলো। টাইটান সাবমেরিনের টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌঁছানোর সময় ছিলো দুই ঘণ্টা কিন্তু সাবমেরিনটি টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌঁছানোর ১৫ মিনিট আগেই টাইটানের সহায়তায় থাকা পোলার প্রিন্স নামক জাহাজের সাথে সকল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২৩ জুন The York Press “পাঁচটি ধ্বংসাবশেষ টাইটানের ভাগ্যের সূত্র দেয়” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় ২২ জুন উত্তর অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে Remotely Operated Vehicle (ROV) -এর মাধ্যমে টাইটান সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। টাইটানের ধ্বংসাবশেষগুলো টাইটানিক জাহাজের থেকে ১৬০০ ফুট দূরে ছিলো।
এ ব্যাপারে গভীর সমুদ্র বিশেষজ্ঞ পল হানকিং বলেন “ আমরা বিধ্বস্ত টাইটানের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ টুকরো খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রথমে পেয়েছিলাম টাইটানের নোজ কোন ( nose cone) (কৌনিক আকারের যা পানির বাধা কমিয়ে দেয়) যেটা প্রেসারহলের (pressure hull) বাইরে অবস্থান করে। এরপর আমরা একটা বড় ধ্বংসাবশেষ পাই। বড় ধ্বংসাবশেষ ক্ষেত্রটার ভিতরে প্রেসারহলের (এই অংশটা সাবমেরিনকে বাইরের চাপ থেকে রক্ষা করে এবং ভিতরে স্বাভাবিক চাপ বজায় রাখে) ফ্রন্ট এন্ড বেল (front-end bell ) পাওয়া যায়। এটা প্রথম ইঙ্গিত ছিলো যে বড় কোন বিধ্বংসী ঘটনা ঘটেছে। এর কিছুক্ষণ পরে আমরা একটি দ্বিতীয় ছোট অংশটা খুঁজে পেয়েছি। ওটার মধ্যে আমরা প্রেসারহলের অন্য অংশটি দেখৈছি – পিছন দিকের বেল (Aft end bell) – যা মূলত সেই সাবমেরিনের সমস্ত চাপ নেয়ার জন্য বানানো হয়েছিল।
তবে এই উদ্ধারকারী দল কাছ থেকে ছবি বা ভিজুয়াল আইডিন্টেফিকেশন এর মাধ্যমে এই ৫ টি বস্তু সনাক্ত করেছেন , নাকি কোনো ধরনের শব্দ বা তরঙ্গের সাহায্যে এদের আকৃতি নির্নয় করেছেন সেটা এই প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। টাইটান সাবমার্সিবল ধ্বংসাবশেষের কাছ থেকে বা দূর থেকে তোলা কোন ছবি ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে কোনো পাবলিক ডোমেইনে খুজে পাওয়া যায়নি।
২৩শে জুন,২০২৩ তারিখে CBSNews এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় টাইটান সাবমেরিন উদ্ধারকার্য চলার সময় উদ্ধারকারীরা ৩০ মিনিট পর পর একট শব্দ শুনতে পান। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে তারা এই শব্দের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত নন। এ ব্যাপারে পানির নিচের ধ্বনিতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং উডস হল ওশানোগ্রাফিক ইন্সটিটিউশনের পরিচালক কার্ল হার্টিসফিল্ড বলেন, “সমুদ্র খুবই জটিল। অবশ্যই এটা মানুষের শব্দ বা প্রকৃতির শব্দ হতে পারে। কিন্তু এই শব্দগুলির উৎসগুলি কী মাঝে মাঝে তা নির্ণয় করা খুব কঠিন।”
তবে ইউএস নেভির অফিশিয়াল শব্দগুলো বিশ্লেষণ করে বলেছে এই শব্দগুলো সমুদ্রের শব্দ অথবা অন্য কোন জাহাজের শব্দ।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ভাইরাল ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেসব তথ্য সঠিক।
কিন্তু ভাইরাল ফেসবুক পোস্টে কিছু ছবিও শেয়ার করা হয়েছে, তার ভিতর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে কিছু জুতার কিছু অংশ বালিতে ডেবে আছে। ভাইরাল ফেসবুক পোস্টগুলো টাইটান সাবমেরিন দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে পোস্ট করায় আপলোড করা ছবিটি টাইটান সাবমেরিন দূর্ঘটনায় নিহত হওয়া যাত্রীদের বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল ছবিগুলোর সত্যতা অনুসন্ধান শুরু করে।
২৩ জুন, ২০২৩ সালে Reuters প্রকাশিত একটা ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে ভাইরাল হওয়া ফেসবুক পোস্টের ছবি সাম্প্রতিক সময়ের না। ছবিটি টাইটান দূর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের ছবিও না। এই ছবিগুলো ২০০৪ সালে কামেরা বন্দী করা হয়। ছবিগুলো ২০০৪ সালে রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ প্রোগ্রাম ইনস্টিটিউট ফর এক্সপ্লোরেশন এবং সেন্টার ফর আর্কিওলজিক্যাল ওশানোগ্রাফি (Institute for Exploration and Center for Archaeological Oceanography) এবং ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অফিস অফ ওশান এক্সপ্লোরেশন (National Oceanic and Atmospheric Administration’s Office of Ocean Exploration) অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ওয়েবসাইট ( Associated Press website) এ প্রকাশ করে। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের সাথে থাকা জুতোর এই ছবিগুলো অতীতে গণমাধ্যমে বহুবার এসেছে। ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল টাইটানিকের মর্মান্তিক পরিণতির ১০০ বছর উপলক্ষে ডেইলি মেইলের প্রকাশিত নিবন্ধেও এই ছবিগুলোর উৎস সম্পর্কে বলা হয়।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর National Geographic চ্যানেলের ইউটিউব চ্যানেলে “টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে কোন মৃতদেহ পাওয়া যায় না কেন” এই বিষয়ের উপর একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। উক্ত ভিডিওতে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের বালিতে ডেবে থাকা জুতা গুলোও দেখা যায়। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে কোন মৃতদেহ পাওয়া যায় না কেন এ ব্যাপারে বিখ্যাত চলচিত্র পরিচালক এবং টাইটানিক চলচিত্রের নির্মাতা জেমস ক্যামেরুন বলেন “সেখানে তুমি কোন কঙ্গাল দেখতে পাবে না। হাড়গুলো রাসায়নিক দ্রবণে দ্রবীভূত হয়ে গেছে। ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যে কেউ জুতা জোড়া দেখতে পাবে।”
ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর সত্যতা অনুসন্ধান করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বিভিন্ন ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা এবং গণমাধ্যম। সেগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
উল্লেখ্য ১৯১২ সালের ১০ই এপ্রিল টাইটানিক নামক বিশাল প্রমোদতরী জাহাজ ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন থেকে নিউ ইয়ার্ক সিটির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৪ই এপ্রিল উত্তর আর্টলান্টিক মহাসাগরের নিউফাউন্ডলান্ডে এর দক্ষিণ-পশ্চিমে বরফখন্ডের সাথে ধাক্কা লেগে টাইটানিকে চিড় ধরে এবং পানি ঢুকে যায়। জাহাজটি ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ভিতর ডুবে যায় এবং প্রায় ১৫০০ মানুষ মারা যায়। এটিকে ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক নৌ দূর্ঘটনা বলে অভিহিত করা হয়।
সিদ্ধান্ত
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে ভাইরাল পোস্টগুলোর ক্যাপশনে থাকা তথ্যগুলো ঠিক থাকলেও যে ধ্বংসাবশেষের ছবি আপলোড করা হয়েছে সেগুলো সাম্প্রতিক সময়ের টাইটান দূর্ঘটার না। এগুলো শতাধিক বছরের পুরনো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের ছবি। এ কারণে ফ্যাক্টওয়াচ ভাইরাল পোস্টগুলোকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
এই নিবন্ধটি ফেসবুকের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের নীতি মেনে লেখা হয়েছে।। এর উপর ভিত্তি করে ফেসবুক যে ধরণের বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন এখানে। এছাড়া এই নিবন্ধ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন, সম্পাদনা কিংবা আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য আবেদন করতে এই লিঙ্কের সাহায্য নিন।