“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোট বাংলাদেশের দুই টাকা”- কতটা সত্য?

21
“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোট বাংলাদেশের দুই টাকা”- কতটা সত্য? “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোট বাংলাদেশের দুই টাকা”- কতটা সত্য?

Published on: [post_published]

গত জুলাই মাস থেকে “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোট বাংলাদেশের দুই টাকা” এমন শিরোনামে বেশ কিছু ফেসবুক পোস্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে জানা যায়, খবরটি ২০১২ সালের এবং রাশিয়ার একটি বিনোদন পত্রিকা এরকম একটি জরিপ পরিচালনা করে। কিন্তু বর্তমানে প্রকাশিত খবরের কোথাও উল্লেখিত জরিপের নাম বা কোনো ধরনের তথ্যসূত্র দেওয়া হয়নি। সংবাদটি নয় বছর পুরানো হওয়ায় এবং বর্তমানে এর প্রাসঙ্গিকতা না থাকায় ফ্যাক্টওয়াচ এটিকে “বিভ্রান্তিকর” হিসেবে চিহ্নিত করছে।

গত জুলাই মাস থেকে “ক্যাম্পাসিয়ান পরিবার”, ” তথ্য ভান্ডার” কিংবা “বইয়ের শহর” সহ এমন বিভিন্ন ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপের মাধ্যমে উক্ত শিরোনামে অনেকগুলো ফেসবুক পোস্ট প্রকাশিত হয়। এছাড়াও অনেক ফেসবুক-ব্যবহারকারী তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমেও তথ্যটি শেয়ার করেন। এর ফলে এই খবরটি ফেসবুকে ভাইরাল হতে শুরু করে।

ফেসবুকে এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

 

এছাড়াও কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টালেও এই খবরটি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরগুলো দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

 

পোস্টের বিষয়বস্তু

মূলত দাবি করা হচ্ছে, ২০১২ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংকনোট নিয়ে “রাশিয়ার একটি বিনোদন পত্রিকা” একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের “দুই টাকা” নোটটি  পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নোট হিসেবে বিজয়ী হয়। সেখানে আরো বলা হয়, জরিপে দ্বিতীয় হয়েছে সাও টোমের ৫০ হাজার মূল্যমানের ডোবরা নোট। তৃতীয় ও চতুর্থ হয়েছে যথাক্রমে বাহামার এক ডলার এবং বাহরাইনের ৫ দিনার। এছাড়াও বাংলাদেশের দুই টাকার উল্লেখিত নোট নিয়ে বিস্তারিত অনেক কিছু বলা হয়। সবশেষে বলা হয়,”একসময় বাজার থেকেও নোটটি হারিয়ে যেতে বসে। ফলে সরকার দুই টাকার কয়েন বাজারে ছাড়ে। নতুন নোট ছাড়া হয় না বলে পুরনো নোটগুলোর ছেঁড়াফাড়া দশা। একসময় হয়তো এই সুন্দর নোটটি একেবারে হারিয়ে যাবে।

 

অনুসন্ধান

ফেসবুকে প্রকাশিত এই তথ্যটি অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, সেখানে রাশিয়ান যে বিনোদন পত্রিকার কথা বলা হচ্ছে কোথাও সেই পত্রিকার কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। এমনকি যে জরিপের কথা বলা হচ্ছে সেই জরিপ নিয়েও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেখতে পাওয়া যায় না। খবরে শুধুমাত্র “রাশিয়ার একটি অনলাইন বিনোদন পত্রিকার জরিপ” এই কথাটি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু শুধুমাত্র এই কথাটির মাধ্যমে ঐ পত্রিকা কিংবা জরিপ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।

পরবর্তীতে এই খবরের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, “Panarmenia.net” নামক আরমেনিয়ার একটি নিউজ এজেন্সি ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারি “Bangladesh taka voted most beautiful bank note“- শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়,”Bangladesh 2 taka note was ranked 1st among the most beautiful bank notes worldwide, according to a poll at Russian online entertainment outlet“। আমাদের অনুসন্ধান অনুযায়ী এটিই সর্বপ্রথম উৎস হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।

 

ঠিক এর দুইদিন পর ৯ জানুয়ারি তৎকালীন “আমার দেশ” পত্রিকার অনলাইন মাধ্যমে “Panarmenia” এর বরাত দিয়ে খবরটি প্রকাশিত হয়। একই দিনে “Bangla News 24” এ এই খবর নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেখতে পাওয়া যায়। যার সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবরের মিল পাওয়া যায়। ধারণা করা যাচ্ছে, এই সংবাদমাধ্যমগুলোর মাধ্যমেই খবরটি বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

 

কিন্তু “Panarmenia”, “আমার দেশ” কিংবা “Bangla News 24” কোনো সংবাদ মাধ্যমেই ওই জরিপ সম্পর্কে কোনো সঠিক ধারণা দেওয়া হয়নি। যার ফলে কিসের ভিত্তিতে এমন একটি দাবি করা হচ্ছে তা পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে ৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে “ডেইলি বাংলাদেশ” নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নোট বাংলাদেশের দুই টাকা” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই সংবাদটির সাথে বর্তমানে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বেশিরভাগ পোস্টগুলো হুবুহু মিলে যাচ্ছে। যেমন উপরে ‘বিষয়বস্তুতে’ দুই টাকার নোট নিয়ে যে উক্তিটি উল্লেখ করা হয় তার সাথে এই প্রতিবেদনের হুবহু মিল রয়েছে। এখানেও দুই টাকার এই নোট নিয়ে বলা হয়,” একসময় বাজার থেকেও নোটটি হারিয়ে যেতে বসে। ফলে সরকার দুই টাকার কয়েন বাজারে ছাড়ে। নতুন নোট ছাড়া হয় না বলে পুরনো নোটগুলোর ছেঁড়াফাড়া দশা। একসময় হয়তো এই সুন্দর নোটটি একেবারে হারিয়ে যাবে”।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান “ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক নোট সোসাইটি” প্রতিবছর “ব্যাংক নোট অব দ্য ইয়ার” নির্বাচিত করে থাকে।  ২০১২ সালে “ব্যাংক নোট অব দ্য ইয়ার” ঘোষিত হয় কাজাখস্তানের ‘5000 Tenge’ ব্যাংকনোটটি। সেখানে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং ওমানসহ আরোও বিভিন্ন দেশের ব্যাংকনোট নমিনেশন পেলেও কোথাও বাংলাদেশের কোনো নোটের নাম দেখতে পাওয়া যায় না।

 

২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের কোনো নোট এখন পর্যন্ত “ব্যাংক নোট অব দ্য ইয়ার” জিতেনি। তবে এর আগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ১০০০ টাকার ব্যাংক নোট নমিনেশন পায়। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০ টাকার একটি ব্যাংক নোট প্রচলন করে। পরবর্তীতে এই নোটটি ২০২০ সালের “ব্যাংক নোট অব দ্য ইয়ারে” পুনরায় নমিনেশন পায়। এই নমিনেশনের কারণেও পুরানো এই খবরটি আবার ভাইরাল হয়ে থাকতে পারে।

 

এছাড়াও, আইবিএনএস সম্পর্কে বিস্তারিত এবং ২০০৪ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিজয়ীদের নাম জানুন এখানে

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সংবাদটি বেশ পুরানো। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় সম্ভবত ৭ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে। অর্থাৎ, আজ থেকে কমপক্ষে প্রায় নয় বছর আগে। ২০২১ সালে এসে এই খবরের কোনো প্রাসঙ্গিকতা দেখা যাচ্ছে না। এত পুরনো একটি সংবাদের বর্তমানে কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়া এইভাবে ভাইরাল হওয়া স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করছে। যদিও সংবাদে ২০১২ সালের কথা উল্লেখ আছে তবুও অনেক ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছে সংবাদটি সাম্প্রতিক। যার ফলে সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ব্যপকভাবে শেয়ার করছেন। বিগত কয়েক বছর ধরেই সংবাদটি মাঝে মধ্যেই ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, ২০২০ সালে ‘বুম বাংলাদেশ’ এর একটি ফ্যাক্টচ্যাকিং প্রতিবেদনে সংবাদটিকে “Misleading” বলে দাবি করা হয়। কিন্তু এই সংবাদের প্রচার অব্যাহত থাকায় ফ্যাক্টওয়াচ এটিকে আবারো যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়।

 

সিদ্ধান্ত

(১) ভাইরাল হওয়া এই খবরটি অনেক পুরানো
(২) উল্লেখিত জরিপ কিংবা রাশিয়ান অনলাইন বিনোদন পত্রিকা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায় নি।
(৩) ব্যাংকনোটের সৌন্দর্য সম্পর্কিত নিয়মিত জরিপ চালায় International Bank Note Society যাদের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো নোট কখনোই বছরের সেরা ব্যাংকনোট হয়ে আসে নি। যদিও ২০০৮ সালে এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকনোট দুইবার মনোনয়ন পেয়েছিল।

বাংলাদেশের ব্যাংকনোট IBNS মনোনয়ন পাওয়ায় এটা বলা যায় যে, বাংলাদেশী ব্যাংকনোটের পক্ষে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া সম্ভব। কিন্তু উল্লেখিত দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ না থাকায় এবং সংবাদটি অনেক পুরনো হওয়ায় ফ্যাক্টওয়াচ একে বিভ্রান্তিকর আখ্যা দিচ্ছে।

 

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@factwatch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ facebook.com/fwatch.bangladesh

 

No Factcheck schema data available.