সম্প্রতি “ইন্দোনেশিয়ায় কোরআনের হাফেজ কে মাটি দেয়ার সময় কবর আলোকিত হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ্” এমন শিরোনামে কয়েকটি ছবি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হতে দেখা যায়। ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধানে দেখা যায়; ১) ছবিগুলো ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তোলা অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৫ বছর পুরনো, ২) কবরে যে আলো দেখা যাচ্ছে তার উৎস সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে অধিকাংশ তথ্যই দাবি করছে সূর্যের প্রতিফলনের কারণে এমন হয়েছে এবং ৩) মূল ঘটনাটি ইন্দোনেশিয়ায় নয় বরং মালয়েশিয়ায় ঘটেছিল। মৃত ব্যাক্তির পরিবারের লোকজনের বরাত দিয়ে মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যমের ২০১৬ সালে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন থেকে বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া যায়। অতএব, ফ্যাক্টওয়াচের বিবেচনায় ত্রুটিপূর্ণ শিরোনামে ভাইরাল এই পুরনো ছবিগুলো “বিভ্রান্তিকর”।
ভাইরাল এই পোস্টগুলোতে তিন থেকে চারটি ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ছবিগুলো দেখে এমন মনে হচ্ছে যে, অনেকজন মিলে কারোও কবরে মাটি দিচ্ছে। যদিও সেখানে মৃত ব্যক্তির কোনো ছবি কিংবা পরিচয় দেখতে পাওয়া যায় না। মোটামুটি সবগুলো ছবিতেই অস্বাভাবিক আলো চোখে পড়ে। মূলত এই ব্যপারটিই ভাইরাল এই পোস্টগুলোর মূল বিষয়। এই অস্বাভাবিক আলোর কারণ হিসেবে সেখানে বলা হয় যে, ইন্দোনেশিয়ায় কোরআনের হাফেজকে মাটি দেওয়ার সময় এইভাবেই কবর আলোকিত হয়ে যায়।
ফ্যাক্টওয়াচের অনুসন্ধান
ভাইরাল এই ছবিগুলোর মাধ্যমে আলাদা আলদাভাবে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে “bharian.com” নামে মালয়েশিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের একটি পুরনো প্রতিবেদন সামনে আসে। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে “Viral luminous grave: Probably the light of Dhuha, the camera lens – family” শিরোনামে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বর্তমানে ভাইরাল হওয়া সবগুলো ছবিই খুঁজে পাওয়া যায়৷
এ থেকে বুঝা যায় যে, বর্তমানে ভাইরাল এই ছবিগুলো সাম্প্রতিক সময়ের নয়, কমপক্ষে ২০১৬ সালের।
পরবর্তীতে প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করলে জানা যায়, যার কবরকে কেন্দ্র করে বর্তমানে এই ছবিগুলো ভাইরাল হচ্ছে সেই ব্যাক্তির নাম মোহাম্মদ খাইরি যাইনুদ্দিন এবং তিনি ৪৫ বছর বয়সে ২০১৬ ডিসেম্বরে মারা যান। সেসময় তাঁর কবরকে কেন্দ্র করেই সামাজিক মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে এমন কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
ভাইরাল এই ছবিগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ছবিগুলোতে কবরের আলোর উৎস হিসেবে পরিষ্কারভাবে কিছু বলা না হলেও এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, মনে হচ্ছে আলোর উৎসটা কবরের ভেতর থেকে আসছে বা মৃতব্যাক্তিকে কেন্দ্র করে চারপাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ অলৌকিকভাবে মৃত ব্যক্তির কবর এবং তার চারপাশ থেকে আলো বেরিয়ে আসছে।
কিন্তু এই একই প্রতিবেদনে এই ব্যাপারে মৃত ব্যক্তির ছোট ভাই ৪১ বছর বয়সী নাজরি যাইনুদ্দিন (Nazri Zainuddin) বলেন যে, কবরস্থানে দাফনকাজ করার সময় অস্বাভাবিক কোনো কিছুই ঘটেনি।”
এছাড়াও প্রতিবেদনে আরোও বলা হয় মৃত ব্যক্তির পরিবার তৎকালীন সময়ে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর বিষয়ে অবগত ছিলেন। নাজরি যাইনুদ্দিনের মতে,” আমাদের কাছে মনে হয়নি এটি কোনো অবাক করার মত বিষয়। যখন এই ভাইরাল ছবিগুলো দেখলাম তখন কোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে এই ভয়ে আমরা কোনো বক্তব্য প্রকাশ করিনি”। এই প্রতিবেদনের মতে এই আলো হতে পারে “লাইট অফ ‘ধোহা’ (Dhuha) অথবা হতে পারে এটি ক্যামেরার লেন্সের কোনো সমস্যা। তবে মৃত ব্যাক্তির ভাইয়ের বক্তব্যে এইটুকু নিশ্চিত যে সেদিন সেখানে সবকিছু স্বাভাবিকই ছিলো, সমস্যার শুরু হয় ধারণকৃত ছবিগুলোর কারণে।
ছবিগুলোর ব্যাখ্যা
ইতিমধ্যে পাওয়া বিভিন্নি কি-ওয়ার্ডের ভিত্তিতে পুনরায় গুগল সার্চ করা হলে আরেকটি প্রতিবেদন চোখে পড়ে। “It’s the reflection of light from the phone’s camera” শিরোনামের এই প্রতিবেদনে ‘নেগেরি সিম্বেলিয়ানে’র ডেপুটি মুফতি নুর আযামির ইলিয়াস (Nor Azamir Alias) নামের একজনের বরাত দিয়ে বলা হয়, মোবাইল ক্যামেরায় আলোর প্রতিফলনের কারণে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। সেখানে মুফতি আরোও দাবি করেন, “দাফনের সময় সেখানকার তাঁবুগুলো ছেঁড়া ছিলো এবং সময়টা সকাল ১০ টা অর্থ্যাৎ সূর্যোদয়ের সময় হওয়ায় ছিদ্রগুলো দিয়ে আলো আসছিলো তাই আমার মতে ঘটনাক্রমে এমন হয়েছে”।
তবে প্রতিবেদনে উল্লেখিত সূত্রতে ক্লিক করলে “Sinar Harian” নামের মালয়েশিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইট পাওয়া যায়। তবে সেখানে এমন কোনো খবর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
একই দাবি করছে এমন আরেকটি প্রতিবেদন থেকে কয়টি পরিষ্কার ছবিও পাওয়া যায়।
উপরের ছবিগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এখানে আলোগুলো সূর্যালোকের প্রতিফলন ছাড়া অস্বাভাবিক কিছু মনে হচ্ছে না।
এগুলো বিবেচনা করে দেখা যায়, ভাইরাল ছবিগুলোর আলো যে অলৌকিক কিছু এমন দাবির স্বপক্ষে কোনো সরাসরি প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি বরং এটি যে আলৌকিক নয় এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, “New Strait Times” এর ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে সিকামত নামে একটি স্থানে (Sikamat) তাঁর দাফন হবে। গুগল ম্যাপের মাধ্যমে জানা যায়, এই সিকামত মূলত মালয়েশিয়ার নেগেরি সেমবিলানে অবস্থিত এবং উপরোল্লিখিত সবগুলো প্রতিবেদনই বলছে যে, মৃত ব্যক্তি নেগেরি সেমবিলানের পিএএস উলামা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। অর্থ্যাৎ, ঘটনাটি মূলত মালয়েশিয়ার, ইন্দোনেশিয়ার নয়।
উল্লেখ্য, মোঃ খাইরি যাইনুদ্দিন হৃদরোগে সমস্যাজনিত কারণে ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। ওইদিন তিনি একটি ধর্মীয় স্কুল পরিদর্শনে ছিলেন এবং হঠাৎই বমি করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
উপরোল্লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে একাধিক অসংগতি চিহ্নিত করা যায়। ১) ছবিগুলো সাম্প্রতিক নয় বরং ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তোলা, ২) কবরের অস্বাভাবিক আলো অলৌকিক কিছু এমন প্রমাণ মিলেনি, এবং মৃতের নিকটাত্মীয়দের সাক্ষ্য অনুযায়ী এমন কিছু ঘটে নি, এবং ৩) ঘটনাটি ইন্দোনেশিয়ায় নয় ঘটেছিলো মালয়েশিয়ায়। তাই অসংগতিগুলো বিবেচনা করে প্রায় পাঁচ বছর পুরনো এই ছবিগুলোকে ফ্যাক্টওয়াচ বিভ্রান্তিকর চিহ্নিত করছে।
আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন? কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন? নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?