নারীর প্রতি সহিংসতা এবং অপতথ্য: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ফ্যাক্ট-চেক বিশ্লেষণ



জুলকার নাঈন
Published on: [post_published]
০৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলের অবসান ঘটে। এর পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এবং লুটপাটের অসংখ্য খবর প্রকাশ্যে আসে। হামলার শিকার হয় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বাসা ও স্থাপনাও। এই ঘটনাবলির পটভূমিতে ধর্মীয় অপতথ্যের ব্যাপক প্রচার হয়। কোটা আন্দোলনের সময় এবং আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিশেষ করে হিন্দু নারী নির্যাতনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবিতে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ছড়িয়ে পড়ে। নারীদের ব্যবহার করে কিভাবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়েছে তা বিশ্লেষণে ঐ সকল দাবির প্রকৃতি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যখনই সহিংসতা, সংঘাত বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তখন নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, আক্রমণ এবং যৌন হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। যে কোন রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় নারীরা প্রায়শই সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় ও তাদের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে। প্রথমত, সংখ্যালঘু নারীরা নির্যাতন ও আক্রমণের শিকার দাবিতে ছড়ানো ধর্মীয় অপতথ্য কি করে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রভাবিত করেছে তা পর্যালোচনা করা। দ্বিতীয়ত, সেসকল অপতথ্য ছড়াতে নারীদের কীভাবে শিকার হিসেবে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে তা উদ্ঘাটন করে। পর্যালোচনাটি ধর্মীয় অপতথ্য ও সংখ্যালঘু নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যকার সম্পর্ককে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে এবং এই সমস্যার সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছে।
নারী সহিংসতা প্রসঙ্গে, সরকার (২০২০) দেখিয়েছেন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টায় প্রায়শই লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার বর্ণনাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেই কি করে ধর্মীয় অপতথ্য ছড়ানো হয়। নারী সুরক্ষা পর্যালোচনায়, বন্দ্যোপাধ্যায় (২০২১) তুলে ধরেছেন যে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি হিন্দু নারীদের লক্ষ্য করে মিথ্যা বর্ণনা দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উস্কে দেয়, যা নারীদের সুরক্ষা ও অধিকারকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে রহমান (২০১৯) দেখিয়েছেন যে, হিন্দু নারীদের ওপর নির্যাতনের মিথ্যা দাবি কৌশলগতভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এ থেকে বোঝা যায়, সংখ্যালঘু নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে পুঁজি করে ছড়ানো অপতথ্যের প্রকৃতি এবং প্রভাব বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য, যাতে ভবিষ্যতে এমন অপতথ্য আরও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে না পারে।
পর্যালোচনার উদ্দেশ্য
এই পর্যালোচনার মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেক রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে নারী প্রতি সহিংসতা এবং অপতথ্যের ধরণ খুঁজে বের করা। বিশেষ করে হিন্দু নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর দাবির প্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ব্যপকভাবে প্রচার করা হয়েছে- তা নির্ধারণ করা এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্য।
তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি
১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ ভারতের বিভিন্ন ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান এবং প্রিন্ট মিডিয়ার ফ্যাক্ট-চেক রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। এই সময়ে মাত্র ২৫টি ফ্যাক্ট-চেক কন্টেন্টে নারী-সম্পর্কিত বিষয়বস্তু খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে ২০টি ফ্যাক্ট-চেক কন্টেন্টে নারীর প্রতি সহিংসতার ভুয়া দাবি ও অপতথ্যের বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ, ৮০ শতাংশ কন্টেন্টে নারী সম্পর্কিত ভুয়া দাবি ও অপতথ্য পাওয়া গেছে। এই প্রেক্ষাপটে “নারীর প্রতি সহিংসতা এবং অপতথ্য” বিষয়ক পর্যালোচনার জন্য ঐ ২০ টি কন্টেন্টের তথ্য, ভিডিও, চিত্র এবং দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্ট-চেকিং রিপোর্ট ও বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে
১। কোন ধরণের অপতথ্য ব্যবহার করে ভুক্তভোগী হিসেবে নারীদের উপর সহিংসতার দাবি করা হয়েছে?
২। সাম্প্রতিক সময়ে কেন শুধুমাত্র হিন্দু নারীদেরকে ভুক্তভোগী এবং সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হিসেবে দেখানো হচ্ছে? কেন নারীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রাধান্য দিয়ে এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে?
৩। নারীর উপর নির্যাতন এবং সহিংসতার দাবি কি করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়েছে?
সীমাবদ্ধতা
সহিংসতার ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুরের দাবি বিবেচনায় নেয়া হয় নি। ব্যক্তিগত আক্রমণ ও নির্যাতন- বিবেচনায় শুধুমাত্র নারীদের প্রতি সহিংসতার উপর গুরুত্ব দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের চেষ্টা করে হয়েছে।
নারীদের প্রতি সহিংসতা ও অপতথ্যের ধরণঃ ফ্যাক্ট-চেক রিপোর্টের আলোকে বিশ্লেষণ
ফ্যাক্ট-চেক রিপোর্ট অনুযায়ী, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও অপতথ্যের কয়েকটি সাধারণ ধরণ পরিলক্ষিত হয়েছে। এই ধরণগুলোকে বিশ্লেষণ করলে নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রকৃতির পাশাপাশি অপতথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
পুরোনো ভিডিও এবং ছবি ব্যবহার করে (সৌজন্যে – ডিসমিসল্যাব) সাম্প্রতিক ঘটনার সাথে যুক্ত করার মাধ্যমে নারীদের প্রতি সহিংসতার মিথ্যা দাবি করা হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাকে নারীদের প্রতি নির্দিষ্ট ধর্মীয় বা জাতিগত সহিংসতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মিডিয়ায় জনপ্রিয় নারীদের উপর নির্যাতন এবং ঘর-বাড়িতে আক্রমণের মিথ্যা দাবি (সৌজন্যে – আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক) ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষিকাদের হেনস্থার ঘটনাকে (সৌজন্যে-ইন্ডিয়া টুডে) ধর্মীয় আক্রমণের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
নারী প্রতি সহিংসতা এবং অপতথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্যে, ২০টি ফ্যাক্ট-চেক কনটেন্টের মধ্যে ৫৫ শতাংশ (১১টি) কনটেন্টে হিন্দু নারীদের হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের দাবি করা হয়েছে। এছাড়া, ৪৫ শতাংশ (৯টি) কনটেন্টে মুসলমান নারীকে (সৌজন্যে – বিডিনিউজ ২৪, রিউমার স্ক্যানার, এবং রিউমার স্ক্যানার) হিন্দু পরিচয়ে সহিংসতার শিকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৪০ শতাংশ (৮টি) কনটেন্টে, জুলাই এবং আগস্ট মাসে ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের ঘটনাকে (সৌজন্যে – যুগান্তর, ডিসমিসল্যাব, ডিসমিসল্যাব, এবং আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক) হিন্দু নারীদের ওপর আক্রমণ এবং অত্যাচার হিসেবে দেখানো হয়েছে। ৩০ শতাংশ (৬টি) কনটেন্টে, ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে নারীর ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার দাবি উঠেছে, যার অধিকাংশ ভিডিওতেই সংখ্যালঘু নারীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, মাত্র ১৫ শতাংশ (৩টি) কনটেন্টে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীদের ঘটনা (সৌজন্যে – বুম ইন্ডিয়া) উঠে এসেছে, তবে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব ঘটনা নারী প্রতি সহিংসতা বা সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষিতে, ২০টি ফ্যাক্ট-চেক কনটেন্টের মধ্যে ২৫ শতাংশ (৫টি) কনটেন্টে দাবি করা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনে সম্পৃক্ত ছাত্রীদের ইস্যু করে (সৌজন্যে- আজতক বাংলা ফ্যাক্টচেক) হিন্দু নারীদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ হয়েছে।
এছাড়া, ২০ শতাংশ (৪টি) কনটেন্টে দাবি করা হয়েছে যে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম শিক্ষিকাদের হিন্দু পরিচয়ে বাধ্যতামূলক পদত্যাগ করানো হয়েছে। আগস্ট মাসে আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে মুসলিম শিক্ষিকাদের হেনস্থার ভিডিও হিন্দুদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা হিসেবে অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
নারীরাই কি সাম্প্রদায়িক হামলার অন্যতম শিকার?
অপতথ্য ছড়িয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা একটি পুরনো কৌশল। যেমন, হিন্দু নারীদের উপর নিপীড়নের ভুয়া ভিডিও এবং ছবি ব্যবহার করে সমাজে একটি বিশেষ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয় যে, হিন্দু সম্প্রদায় অব্যাহতভাবে আক্রমণের শিকার। নারীদের ব্যবহার করে যে সকল সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দাবি করা হয়েছে, সেগুলোর পেছনের কারণ কি? কিভাবে নারীদের সামাজিক অবস্থান ও কোটা আন্দোলনের নারী প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ গুজব ও অপতথ্যের চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
দলিত হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করার মিথ্যা দাবি (সৌজন্যে- ডিসমিসল্যাব) এবং যৌন নির্যাতনের পুরানো ভিডিওর ব্যবহার করে সহিংসতার যে বিভ্রান্তিকর দাবি (সৌজন্যে – বুম ইন্ডিয়া) করা হয়েছে যা সামাজিকভাবে স্পর্শকাতর। স্কুল কলেজে হিন্দু শিক্ষিকা এবং কলেজের অধ্যক্ষাকে পদত্যাগে বাধ্য করা (সৌজন্যে – রিউমার স্ক্যানার ও ডিসমিসল্যাব) এবং হিন্দু মেয়েকে মুসলিম ছেলেরা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার (সৌজন্যে – ফ্যাক্টওয়াচ) ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে হিন্দু নারীদের ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে, মুসলিম নারীকে হিন্দু নারী দাবি করা হয়েছে। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের অপব্যবহার ( (সৌজন্যে – আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক) করে হিন্দু নারীরা সাম্প্রদায়িক হামলার অন্যতম শিকার হিসেবে দেখানোর প্রধান উদ্দেশ্য সমাজে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারী নেত্রীদের উপর হামলার ঘটনাকে (সৌজন্যে – ফ্যাক্টওয়াচ) হিন্দু নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে, যা মূলত প্রকৃত ঘটনা থেকে বিচ্যুত।
সামাজিকভাবে নারীরা নিরাপত্তা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং নির্যাতনের শিকার, যার ফলে তাদেরকে নিয়ে প্রচারিত মিথ্যা তথ্য এবং গুজব সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে কোন গুজব ও অপতথ্যের শিকার হিসেবে, নারীদের এই প্রতীকী অবস্থানকে ফুটিয়ে তোলা হয় যা পুরো সমাজে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। নারীকে এই অপতথ্যের লক্ষ্য বানিয়ে, রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করা হয়, যা মূলত একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যের অংশ।
যৌন সহিংসতার ভুয়া দাবিঃ সম্প্রদায়িক বিভাজনের হাতিয়ার
ভিন্ন ঘটনার ভিডিও এবং ছবি ব্যবহার করে চমকপ্রদ এবং সেনসেশনাল কন্টেন্ট তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। পুরোনো ভিডিওকে নতুন ঘটনার (সৌজন্যে – রিউমার স্ক্যানার) সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটি প্রাসঙ্গিক সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করা হয়, যা সেনসেশনাল অপতথ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়তা করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ছাড়াও এই ধরনের দাবি মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণকারী হিসেবে উপস্থাপন করে। যা হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনকে গভীর করে তোলে।
গুজব ও অপতথ্যের ক্ষেত্রে নারীদের চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার মূল কারণ হলো পরিস্থিতিকে সেন্সিটাইজ করা এবং জনগণের আবেগকে উস্কে দেওয়া। ধর্ষণ, অপহরণ, এবং নির্যাতনের ঘটনা (সৌজন্যে – রিউমার স্ক্যানার), যা সত্য না হলেও প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ধরনের অপতথ্য মূলত রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ছড়ানো হয়, যাতে আন্দোলনের নারীদের অংশগ্রহণকে নেগেটিভ আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত করা যায়।
রাজনৈতিক ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক করার প্রচেষ্টা
বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেত্রীদের উপর হামলার ঘটনাকে (সৌজন্যে – ফ্যাক্টওয়াচ) হিন্দু নারীদের উপর নিপীড়নের মিথ্যা দাবিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পিলারের সঙ্গে বেঁধে রাখা ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীর ভিডিও মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে এটি হিন্দু নারীদের উপর অত্যাচারের প্রমাণ হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা রাজনৈতিক আন্দোলনকে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেত্রীর মুখ বেঁধে রাখার ছবিকে হিন্দু নারীর ওপর আক্রমণ (সৌজন্যে – আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক) এবং ছাত্রলীগ কর্তৃক নারী শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করার ঘটনাকে (সৌজন্যে – ফ্যাক্টওয়াচ) ভুলভাবে জিহাদী কর্তৃক হিন্দু মেয়েদের হত্যার ঘটনা হিসেবে প্রচার- রাজনৈতিক ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে।
উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তারা শুধু স্বশরীরেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি, বরং তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বিভিন্ন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ছাত্রীদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা মূলত তাদের অপতথ্যের অন্যতম চরিত্র হিসেবে পরিণত করেছে। নারীরা যখন আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন, তখনই তারা অপতথ্যের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। আন্দোলনের সময় অসংখ্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নেত্রী ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনাগুলোকেও অপতথ্য ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা, হিন্দুদের সংখ্যালঘু হিসেবে দাবি করার প্রচেষ্টা, মূল রাজনৈতিক ইস্যু থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কৌশলগত কারণ বলে ধারনা করা হয়।
নারী সহিংসতার অপব্যবহারঃ ধর্ম রাজনীতির নতুন কৌশল
নারী সহিংসতার অপতথ্য ছড়িয়ে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা ইতিহাসে নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আরও গভীরতর হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে যখন হিন্দু নারীকে ব্যবহার করা হয়েছে। সহিংসতা দেখিয়ে একটি রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের প্রচেষ্টায় সংখ্যালঘু নারীদের ব্যবহার এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল বলে ধারণা করা হয়।
এই প্রক্রিয়ায়, নারীকে ধর্মীয় আইডিওলজির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদের প্রতি সহিংসতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ঐ সম্প্রদায়কে নিপীড়িত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অতএব, ধর্মীয় হাতিয়ার হিসেবে নারী সহিংসতা একটি গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
নারী সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতাঃ দ্বৈত প্রতিবন্ধকতার জটিলতা
বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে সাম্প্রদায়িকতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। যখন একটি সম্প্রদায়কে নির্যাতনের শিকার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তখন অন্য সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ে। বিশেষ করে, লিঙ্গ-ভিত্তিক অপতথ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির নতুন কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। লিঙ্গ-ভিত্তিক অপতথ্য একদিকে নারী সহিংসতাকে উস্কে দেয়, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তোলে। এ প্রক্রিয়া সমাজে দ্বৈত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা নারী এবং সংখ্যালঘু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। প্রথমত, নারীদের প্রতি সহিংসতা এবং তাদের অবস্থান প্রান্তিক করার মাধ্যমে সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আরও গভীরতর হয়। দ্বিতীয়ত, হিন্দু নিপীড়নের দাবি এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক অপতথ্য সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে উসকে দেয়, যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আঘাত হানে। নারীদের উপর সহিংসতা বা অপতথ্য ছড়িয়ে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, সমাজে দীর্ঘস্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য তৈরি হয়, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
পরিসমাপ্তি
সম্প্রতি নারী সহিংসতাকে কেন্দ্র করে ছড়ানো বেশিরভাগ ধর্মীয় অপতথ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত। সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ছড়ানো এই অপতথ্য প্রায়ই সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেয়। এছাড়া, নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্লেষণে চৌধুরী (২০২২) দেখিয়েছেন, লিঙ্গ-ভিত্তিক অপতথ্য কীভাবে নারীদের অবস্থান এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে আরও প্রান্তিক করে তোলে। সর্বশেষে, নারীদের ব্যবহার করে লিঙ্গ-ভিত্তিক অপতথ্য ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা অত্যন্ত উদ্বেগজনক; এই ধরনের মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা একান্ত জরুরি।
দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্ম রাজনীতি একই সূত্রে গাঁথা। ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতির খেলা এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় উদ্বেগ সৃষ্টি করে, যা সহজেই সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেওয়ার পথ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একটি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা ভাংচুর ও লুটপাট চলানো হয়েছিল সেটি ছিল রাজনৈতিক স্বার্থে। ঐ চক্রান্তমূলক ঘটনার পিছনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলসহ কিছু ইসলামপন্থী সংগঠনের সম্পৃক্ততা ছিল। অতীতের ঘটনা থেকে এটি আরও স্পষ্ট যে সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে ধর্মীয় সহিংসতার চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই বেশি প্রভাবশালী। ফলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের ব্যবহার করে অপতথ্য ছড়ানোর প্রক্রিয়া এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক করার একটি নতুন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
রেফারেন্স
১। সরকার, এস। (২০২০) । ‘ধর্ম, লিঙ্গ, এবং সহিংসতাঃ দক্ষিণ এশীয় প্রসঙ্গ।’ জার্নাল অফ ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজ।
২। বন্দ্যোপাধ্যায়, পি। (২০২১) । ‘ডিজিটাল নারীবিদ্বেষ: দক্ষিণ এশিয়ায় হিন্দু নারীদের ওপর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব।’ মিডিয়া এবং সোসাইটি জার্নাল।
৩। রহমান, এ। (২০১৯) । ‘বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা এবং মিথ্যা তথ্যের রাজনীতি।’ সাউথ এশিয়ান রিভিউ অফ পলিটিক্স।
৪। চৌধুরী, এন। (২০২২) । ‘দক্ষিণ এশিয়ায় লিঙ্গভিত্তিক ভ্রান্ত ধারণা: চ্যালেঞ্জ এবং প্রভাব।’ ফেমিনিস্ট মিডিয়া স্টাডিজ
৫। ফ্যাক্ট-ওয়াচ। (২০২৪) । বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার ভুয়া তথ্য।’ ফ্যাক্ট-ওয়াচ। প্রাপ্তির তারিখ: https://www.fact-watch.org/communal-attack-thread/
৬। ইন্টারনেট গভারনেন্স ফোরাম। (এন.ডি.) । ‘দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সাইবার সহিংসতা: একটি আঞ্চলিক মূল্যায়ন।’ ইন্টারনেট গভারনেন্স ফোরাম। প্রাপ্তির তারিখ: https://intgovforum.org/en/filedepot_download/248/21181
৭। আচার্য, এ। (২০২৩)। নারী এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের লক্ষ্য করে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের প্লাবন।’ 360info। প্রাপ্তির তারিখ: https://360info.org/the-disinformation-deluge-targeting-women-and-gender-diverse-people/
৮। এ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোগ্রেসিভ কমিউনিকেশনস। (২০২১) । ‘লিঙ্গভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্যকে মানচিত্রে স্থাপন: গবেষণা ও প্রচারণার কৌশল।’ এ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোগ্রেসিভ কমিউনিকেশনস। প্রাপ্তির তারিখ: https://www.apc.org/en/project/placing-gendered-disinformation
৯। গিং, ডি., ও সিয়াপেরা, ই। (২০২৪) । ‘লিঙ্গভিত্তিক বিভ্রান্তিমূলক তথ্য: ভুল তথ্য, লিঙ্গ এবং প্রযুক্তি।’ ফ্যামিন্সিট মিডিয়া স্টাডিজস, ১২(৩), ২৭৫-২৯২। https://doi.org/10.1177/27523543241257715
No Factcheck schema data available.