গবেষণায় কি হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে?

Published on: October 17, 2020 


রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও আইসিডিডিআরবি’র যৌথ জরিপে উঠে এসেছে, রাজধানীর ৪৫ ভাগ মানুষের দেহে তৈরি হয়েছে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অ্যান্টিবডি, বস্তি অঞ্চলে এই হার ছাড়িয়ে প্রায় ৭৪ শতাংশ। গত সোমবার (১২ অক্টোবর) বিকেলে ঢাকায় কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ পরিস্থিতি ও জিন রূপান্তর বিষয়ে রাজধানীর হোটেল লেকশোরে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে এসব তথ্য ওঠে আসে। তবে কি এই গবেষণাটিতে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরির কোন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে?

 

‘হার্ড ইমিউনিটি’ কী?

যখন কোনো জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তখন বাকি সদস্যদের মধ্যে ওই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে আসে। এ পরিস্থিতিকেই বলা হয় ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (Herd immunity)। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ওই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় তারা সংক্রামক রোগটিতে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও তা আর তাদের আক্রান্ত করে না। ফলে ওই রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

 

গবেষণাটিতে কী তবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরির কোন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে?

ইউএসএইড- এর সহায়তায় আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি’র সংক্রমণের পরিসংখ্যানে ঢাকার ২৫টি ওয়ার্ডে ১২ হাজার ৬৯৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং নমুনায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ-উপসর্গ পাওয়া গেছে মাত্র ছয় শতাংশের মধ্যে, মৃদু লক্ষণ ছিল ১২ শতাংশের। এর বাইরে ৮২ শতাংশেরই কোনো লক্ষণ-উপসর্গ ছিল না। আবার লক্ষণযুক্ত এই রোগীদের মধ্যে ১৫ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।

আইসিডিডিআর,বি’র প্রধান গবেষক ডা. ফেরদৌসী কাদরি জরিপের তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, “জরিপ করা ব্যক্তিদের মধ্যে সেরোপোসিটিভিটির হার ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে সক্ষম হচ্ছি।” যদিও প্রাকৃতিকভাবে এ ক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি অন্যান্য বেশিরভাগ গবেষকই নাকচ করে দেয়।

আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বর্তমান পরিস্থিতিটিকে বরং ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধারণা করছেন। তিনি জানিয়েছেন, “হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। এটা আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে একেবারেই ঠিক না। কারণ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটার পরিমাণ অনেক কম এবং দেড় দুই মাসের মাথায় আবার তা কমতে শুরু করে। আর যাদের ক্রিটিক্যাল অবস্থা থাকে, তাদেরও শরীরে পরিমাণ একটু বেশি থাকে। কিন্তু সেটাও তিন মাস থেকে কমতে শুরু করে এবং ছয় মাস পর অ্যান্টিবডি আর থাকে না।” তথ্যসূত্র

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ড: বে-নজীর আহমেদ বলেছেন, “বাস্তব পরিস্থিতিতে ঝুঁকি যে বাড়ছেই, গবেষণায় তা উঠে এসেছে। এছাড়া নিম্ন আয়ের বা কোনো স্তরের মানুষই ঝুঁকির বাইরে নয়, তাও প্রমাণ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

অন্যদিকে, বিশ্বের নানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ভাইরাসটিকে একেবারে ধ্বংস করা সম্ভব নাও হতে পারে। ব্যাপক মাত্রায় কোন কার্যকর ভ্যাকসিন ব্যবহার না করা গেলে আমরা হয়তো এই তথাকথিত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কখনই অর্জন করতে পারব না। বেশ কিছু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাথে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও আলোচনার প্রেক্ষিতে সংবাদমাধ্যম এনপিআর তাদের একটি প্রতিবেদনে এই তথ্যগুলো জানিয়েছে। পড়ুন এখানে

অনুরূপভাবে, নিউজউইকের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা কিংবা এর বিরুদ্ধে হার্ড-ইমিউনিটি অর্জনের আশা মানুষকে উল্টো আরও অসুস্থতা এবং মৃত্যু এনে দিতে পারে। এমনকি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রস আধানম ঘেব্রেইয়েসুস বলছেন “এ জাতীয় পন্থা অবৈজ্ঞানিক ও অনৈতিক”। যদিও, অনেকে মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করতে এবং কিছু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শেই হার্ড ইমিউনিটি পন্থাটি অবলম্বন করছে যা আত্মঘাতী হয়ে উঠবে। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে।

অতএব, বিশেষজ্ঞদের এরূপ আলোচনা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট যে, হার্ড ইমিউনিটির পক্ষে পৃথিবীর কোথাও এখন পর্যন্ত সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী গবেষকরা এ বিষয়ে অভিন্ন কোনো ঐকমত্যেও পৌঁছাননি। তাই আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি’র এই গবেষণায় হার্ড ইমিউনিটি তৈরির কোন প্রমাণ পাবার কথা নয়।

 

তবে কেন আমরা প্রতিনিয়তই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে কথা বলছি?

মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ‘হার্ড ইমিউনিটি’ নিয়ে আলোচনাটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং এই উদ্দীপনার মূলে রয়েছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ আর এই বিস্তর গণমাধ্যম। প্রথম দিকে ধারণা ছিল যে, একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬০ ভাগ মানুষের এই ইমিউনিটি থাকলে ভাইরাসটি আর ছড়াবে না। যদিও সেই অনুমানগুলির উৎস ছিল অসম্পূর্ণ তথ্য এবং সরল পরিসংখ্যান। সময়ের সাথে সাথে বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতভেদ তৈরি হতে থাকে। তবে এই ধারণাটি টিকে থাকার পেছনে আরেকটি কারণ হল এটি জনসাধারণের পূর্বের সেই স্বাভাবিক জীবনযাপনকে সমর্থন করে। এতে করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো যেমন, সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব কিংবা জীবাণুনাশকের ব্যবহার ইত্যাদি না মানলেও চলে। এক কথায়, এতে কিছুই না করে স্বাভাবিক সামাজিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ থাকে। ফলে মানুষের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটির ব্যাপারে স্থায়ী আকাঙক্ষা তৈরি হয়েছে।

তথ্যসূত্র

সারাবাংলার প্রতিবেদনটি পড়ুন

বিবিসির প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনটি পড়ুন এখানে

অন্যান্য প্রতিবেদনগুলি পড়ুন এখানে, এখানেএখানে

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

 

Leave a Reply