দীর্ঘমেয়াদী কোভিড: এ বিষয়ে আমরা কী জানি?

Published on: October 17, 2020 


মহামারির প্রথম দিকে আমরা জানতাম করোনা একটি শ্বাস-প্রশ্বাস-সম্বন্ধীয় রোগ, যা থেকে বেশিরভাগ আক্রান্ত ব্যক্তি মাত্র ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে সুস্থতা লাভ করে। তবে মহামারির দীর্ঘকালীন স্থায়িত্ব এই ধারনারটিও পরিবর্তন এনেছে। এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে, করোনায় আক্রান্ত হওয়া হাজার হাজার মানুষের মধ্যে এ রোগের উপসর্গ থেকে যাচ্ছে মাসের পর মাস।

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর হেল্‌থ রিসার্চের (এনআইএইচআর) একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘দীর্ঘমেয়াদী কোভিড’ কেবল একটি উপসর্গ নয় বরং তাতে আলাদা আলাদা বিভিন্ন রকম উপসর্গ থাকতে পারে যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে একই সময়ে ভোগাতে পারে। দেখে আসা যাক এসব বিষয়ে আমরা এখন কতটুকু জানি।

উপসর্গের বৈচিত্র

দীর্ঘমেয়াদি কোভিড বলতে এখানে বোঝাচ্ছে করোনার প্রারম্ভিক আক্রমন কাটিয়ে ওঠার পরে একটির বেশি, চারটি বা ততোধিক উপসর্গ থেকে যাওয়া। এই উপসর্গগুলোর মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করতে না পারার কারণে অনেকেই উপযুক্ত চিকিত্সা নিতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন গবেষণাপত্রটির প্রধান লেখক ডা. ইলেইন ম্যাক্সওয়েল। রিপোর্টে দীর্ঘমেয়াদী করোনার উপসর্গগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১. আইসিইউ-তে থাকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মানেই সুস্থ হয়ে যাওয়া নয়, বরং একটি দীর্ঘ আরোগ্য প্রক্রিয়ার সূচনা। আইসিইউ-তে নিবিড় তত্ত্বাবধানে থেকে অনেক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী সুস্থতা লাভ করলেও শরীর তবে অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়ায় সাহায্যে ছাড়া উঠে বসতে কিংবা বিছানা থেকে হাত তুলতে তাদের কষ্ট হয়। এমনকি কেউ কেউ কথা বলতে বা খাবার গিলে খেতেও পারেন না। তাদের মধ্যে বিষাদগ্রস্ততা এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক ব্যাধিও লক্ষণীয়।

২. ভাইরাস-পরবর্তী অবসাদ

অনেক দীর্ঘমেয়াদী রোগীদের মধ্যে অস্বাভাবিক ক্লান্তি, মাংসপেশীতে ব্যথা এবং মনোনিবেশ করতে সমস্যা সমূহ লক্ষ্য করা যায়। এই দীর্ঘস্থায়ী অবসাদ উপসর্গটি মূলত কীসের সাথে সম্পর্কযুক্ত তা এখনও তদন্ত করা হচ্ছে। এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী অবসাদ বা ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রম এর আগে এর আগে সংক্রামক এপস্টাইন-বার (Epstein-Barr) ভাইরাস এবং কিউ (Q) জ্বর-এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ২০০৩ সালের সারস (SARS) প্রাদুর্ভাবের সময়কালীন গবেষণাতেও দেখা গেছেযে, সংক্রামিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশের ফুসফুস সুস্থ থাকা সত্ত্বেও শারীরিক ব্যায়াম তাদের জন্য দুঃসহ লাগত।

৩. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি

হাঁফ ধরা বা রুদ্ধশ্বাস বোধ করা, কাশি কিংবা ত্বরিত হৃদস্পন্দন (Racing pulse) – কোভিড-পরবর্তী এসব উপসর্গ ফুসফুস বা হৃৎপিণ্ডের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির লক্ষণ, যদিও এই ক্ষতি চিরস্থায়ী নাও হতে পারে। করোনা আক্রান্ত যেসব রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয়, তাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্ষতির প্রাদুর্ভাব বিশেষ রকম লক্ষনীয়। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতাল ছাড়ার ছয় সপ্তাহ পরেও প্রায় ৫০% রোগী শ্বাসকষ্টের শিকার হন। ছাড়া পাবার ১২ সপ্তাহের মাথায় তা ৩৯%-এ নেমে এসেছিল।

অন্যদিকে, হাসপাতালে নেওয়া রোগীদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে হৃতপিন্ডে ক্ষতির লক্ষণ দেখা যায়। তবে এর চেয়ে কম মাত্রায় আক্রান্তদের মধ্যেও হৃদযন্ত্রের ওপর কোভিড-এর ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যায়। একটি পৃথক গবেষণায় মার্চ মাসে আক্রান্ত ১০০ জন রোগীর এমআরআই (MRI) স্ক্যানে ৭৮ জনের হৃৎপিণ্ডে কাঠামোগত সামান্য পরিবর্তন দেখা যায়। তবে এই পরিবর্তনগুলো সময়ের সাথে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে যকৃত এবং ত্বকের সমস্যার কথাও জানা যায়।

৪. দেহের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তনশীল মাত্রায় সঞ্চারমান উপসর্গ

দীর্ঘমেয়াদী কোভিডের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি হল এমন কিছু উপসর্গ, যা শরীরের বিভিন্ন অংশে আসে যায় এবং বিভিন্ন মাত্রায় ওঠা-নামা করে। এনআইএইচআর-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে এই উপসর্গগুলির মধ্যে একটাই মিল, সেটা হল শরীরের একটি তন্ত্রে কমে আসার পর তা অন্য কোন তন্ত্রে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এমন রোগীদের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানর পর দেখা গেছে যে, ৭০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গের আসা-যাওয়া এবং ৮৯ ভাগ রোগীর শরীরে উপসর্গের মাত্রার ওঠা নামা দেখা যাচ্ছে। এ জাতীয় লক্ষণগুলির অন্তর্নিহিত কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার ব্যাঘাত ঘটার কারণে এমনটি হতে পারে।

দীর্ঘ কোভিডে সব বয়সের মানুষই আক্রান্ত

গবেষনা থেকে প্রাক্কলন করা যায় যে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০% প্রায় তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে উপসর্গ অনুভব করেন এবং ৫০ জনের মধ্যে অন্তত একজন তিন মাসের বেশিও অসুস্থ থাকতে পারেন। এনআইএইচআর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শিশুসহ যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যে এই দীর্ঘমেয়াদী কোভিড-এর লক্ষণগুলো দেখা দেবার সম্ভাবনা থাকে।তবে একটি অপ্রকাশিত সমীক্ষার ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে যে, মহিলা এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা তুলনামূলক দীর্ঘ কোভিড-এর বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এই রিপোর্টের গবেষক কিংস্‌ কলেজ লন্ডনের জেনেটিক এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রফেসর টিম স্পেক্টর বলেছেন আঠারোর বেশ বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে কোভিডের উপসর্গ এক মাসের বেশি সময় ধরে থেকে যাবার সম্ভাবনা বয়সের সাথে বাড়তে থাকে।

প্রতিবেদনটি অনুদিত হয়েছে এখান থেকে

 

আপনি কি এমন কোন খবর দেখেছেন যার সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন?
কোন বিভ্রান্তিকর ছবি/ভিডিও পেয়েছেন?
নেটে ছড়িয়ে পড়া কোন গুজব কি চোখে পড়েছে?

এসবের সত্যতা যাচাই করতে আমাদেরকে জানান।
আমাদেরকে ইমেইল করুনঃ contact@fact-watch.org
অথবা ফেইসবুকে মেসেজ দিনঃ fb.com/search.ulab

 

Leave a Reply